Thursday, October 4, 2012



শিক্ষকদের মিছিলে পুলিশের টিয়ারশেল : রক্ত ঝরল শিক্ষকদের, আহত অর্ধশত, শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি, আলোচনায় বসতে চান প্রধানমন্ত্রী












পুলিশের লাঠিপেটায় রক্ত ঝরল নন-এমপিও শিক্ষকদের। একইসঙ্গে তাদের ওপর ছোড়া হয়েছে কাঁদানে গ্যাসের শেল। পুলিশের হামলায় প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
গতকাল বেলা ১১টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশের অর্ধশতাধিক টিয়ারশেল নিক্ষেপে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। দুর্ভোগে পড়ে মানুষজন।
এদিকে এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনায় বসতে চেয়েছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাদের জানানো হয়েছে। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি মো. এশারত আলী এ তথ্য জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস পাওয়ার পর শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসে আজ শুক্রবারের বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। তিনি জানান, আগামী সোমবার প্রধানমন্ত্রী তাদের সঙ্গে বসবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার কুণ্ডু বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাকে ফোন করে জানানো হয়েছে, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বসতে চেয়েছেন। আগামী রোববার বা সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠক হতে পারে।
এমপিওভুক্তির (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) দাবিতে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চারদিন ধরে কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছিলেন। আন্দোলনরত শিক্ষকদের অভিযোগ, তাদের লাঠিপেটা করে এবং কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে ন্যক্কারজনকভাবে সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সচিবালয় ঘেরাওয়ের জন্য প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে এগোতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে তারা হাইকোর্ট এলাকায় কদম ফোয়ারার সামনে দিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ কাঁটাতারের বাধা সৃষ্টি করে শিক্ষকদের আটকায়। একপর্যায়ে শিক্ষকরা এই বাধা ভেঙে এগোতে গেলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষক আহত হন। তাদের মধ্যে নুরুজ্জামান, সুব্রত কুমার, মনিরুজ্জামান, বাহারুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে শিক্ষকরা প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন।
এ ঘটনায় প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। পাঁচ দফা দাবিতে ‘নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটে’র ব্যানারে আন্দোলনরত শিক্ষক-কর্মচারীরা কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ করছেন। ঐক্যজোটের সভাপতি মো. এশারত আলীর নেতৃত্বে গত বুধবার পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপিতে শিক্ষকরা পাঁচ দফা দাবির কথা উল্লেখ করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— চলতি অর্থবছরে স্বীকৃতি পাওয়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা, স্বীকৃতির সময়কাল থেকে চাকরির বয়স গণনা করা, এমপিওর ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যদের ডিও লেটার দেয়ার প্রয়োজন বিলুপ্ত করা, এমপিও প্রদানে অনিয়ম, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করা এবং স্বীকৃতি পাওয়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন না দেয়া।
আন্দোলনরত শিক্ষকরা জানান, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৪ হাজার ৪৮৪টি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে আসছেন। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিবের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেও কোনো আশ্বাস মেলেনি। সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর শিক্ষকরা শিক্ষা সচিবের সঙ্গে বসলেও তিনি সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি।
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের সভাপতি এশারত আলী অভিযোগ করে বলেন, তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। সরকার এমপিওভুক্তির ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত রাস্তা ছেড়ে ঘরে ফিরে যাবেন না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশেই প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষককে পিটিয়েছে পুলিশ। শিক্ষকদের অধিকারকে পদদলিত করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। তিনি জানান, শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তির দাবি করে আসছেন। তাদের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে গতকাল সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ছিল। এ সময় পুলিশ শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায়।
পুলিশের রমনা জোনের এসি শিবলী নোমান বলেন, সচিবালয়ের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছিল। শিক্ষকরা নিয়ম ভেঙে দুপুর ১২টার দিকে তা সরাতে যায়। এ সময় নিয়ম মেনে তাদের সরিয়ে দেয়া হয়। কারও ওপর হামলার কোনো প্রশ্নই আসে না।
তবে রমনা বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার সৈয়দ নুরুল ইসলাম জানান, গতকাল বেলা ১১টার দিকে শিক্ষকরা মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে এগোলে তাদের বাধা দেয়া হয়। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষকরা বাধা ডিঙিয়ে সামনের দিকে যেতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এক পর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে বাধ্য হয়।
প্রসঙ্গত, এমপিওভুক্তির দাবিতে গত সোমবার নতুন করে এ আন্দোলন শুরু করেন নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা। মঙ্গলবারও তারা দিনভর প্রেস ক্লাব ও শাহবাগ এলাকায় বিক্ষোভ করেন এবং বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেন।
শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চান শিক্ষকরা : নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের পূর্বঘোষিত সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশি মারধরের শিকার হয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন। তারা বলছেন, টানা চারদিন ধরে তারা আন্দোলন করছেন। তাদের দাবির বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোনো প্রকার যোগাযোগ করা হয়নি। উল্টো তাদের ওপর পুলিশ টিয়ারশেল ছুড়েছে। এ ঘটনার পর বেলা ২টার দিকে শিক্ষকরা সচিবালয় ও প্রেস ক্লাবের মাঝখানের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবিতে নানা স্লেম্লাগান দেন। তাদের অভিযোগ, শিক্ষামন্ত্রী এ পর্যন্ত এমপিওভুক্তি নিয়ে স্পষ্ট কোনো কথা বলেননি।
দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান মিজানুরের : আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি মেনে নিতে সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান। গতকাল বিকালে শিক্ষকদের সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি নিজেও শিক্ষক। শিক্ষকদের ব্যথায়, মর্মবেদনায়, আন্দোলনে সহমর্মিতা প্রকাশ করা ছাড়া আমার কোনো গতি নেই। শিক্ষকদের হেয় করে কোনো জাতি কখনও বড় হতে পারে না। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষকদের দাবি মেনে নেয়ারও দাবি জানান তিনি।