
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ব্যাপারে একমত হতে পারেননি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের সাত বিচারপতি। চারজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন দুইজন বিচারপতি। অন্য একজন বিচারপতি বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল বলে ঘোষিত হয়েছে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে সংযোজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাত বিচারপতি গতকাল স্বাক্ষর করেছেন। গত বছর ১০ মে এ রায়টি দেয়ার ১৬ মাস পর গতকাল রায়ের চূড়ান্ত কপিতে স্বাক্ষর করলেন বিচারপতিরা। গত রাতেই রায়টি সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে রায়টি প্রকাশের ১৪ মাস আগেই সরকার এই রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার জন্য বিরোধী দল অনড় অবস্থান নিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দিয়ে রায়ে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ সংবিধান পরিপন্থী এবং এ কারণে একে বাতিল ঘোষণা করা হলো।’
রায়ে স্বাক্ষরের আগে বৈঠকে বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, রায় ঘোষণাকালের প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী অংশ নেন।
বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ৭৪৭ পৃষ্ঠার এ রায় লেখা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রায় বাংলা ও ইংরেজিতে মিলিয়ে লেখা হলো। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের লেখা রায়ের ৩৪২ পৃষ্ঠার মূল অংশটি তিনি বাংলায় লিখেছেন। তার সঙ্গে একমত হয়েছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।
এই রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি ১৫০ পৃষ্ঠার অভিমত লিখেছেন।
আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার বিষয়ে পূর্ব ঘোষিত অভিমত থেকে পূর্ণাঙ্গ রায়ে অনেকটা সরে এসেছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা। রায় ঘোষণার দিন প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত অভিমতে বলা হয়েছিল আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকতে পারে। তবে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করবে। গতকাল প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের লেখা রায়ের ৩৩৯ নং পৃষ্ঠায় ২নং প্যারায় বলা হয়েছে- ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু জনগণের নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্যগণ দ্বারা গঠিত হইতে পারে। কারণ, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতা, গণতন্ত্র, প্রজাতান্ত্রিকতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের নধংরপ ংঃত্ঁপঃঁত্ব (মৌলিক কাঠামো) এবং এই রায়ে উক্ত বিষয়গুলির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবার ক্ষেত্র, জাতীয় সংসদের বিবেচনা অনুসারে যুক্তিসঙ্গত কালপূর্ব যথা ৪২ দিন পূর্বে সংসদ ভাঙ্গিয়া দেয়া বাঞ্ছনীয় হইবে। তবে নির্বাচন পরবর্তী নতুন মন্ত্রিসভা কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভা সংক্ষিপ্ত আকার গ্রহণ করত উক্ত সময়ের জন্য রাষ্ট্রের স্বাভাবিক ও সাধারণ কার্যক্রম পরিচালনা করিবেন।’
এদিকে ভিন্নমত পোষণ করে রায় দেয়া বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞার অভিমতে বলা হয় ‘ তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ত্রয়োদশ সংশোধনী) সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হলে নিশ্চিতভাবেই দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। ... ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংবিধানিক অপরিহার্যতা।’
আপিল বিভাগের তত্কালীন সাত বিচারপতির মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে মতামত দিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এছাড়া বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়ার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। মামলার শুনানি ও রায় দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক।
রায় প্রদানকারী সাত বিচারপতি গতকাল দুপুরে বৈঠক করে রায়ের চূড়ান্ত কপিতে স্বাক্ষর করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর সন্ধ্যার আগেই তারা পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্বাক্ষর করেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক গতকাল সুপ্রিমকোর্টে কয়েক দফা বৈঠকে বসেন রায় দেয়ার সময় বিচারকের আসনে বসা অন্য ছয় বিচারপতির সঙ্গে। তখন তত্পর দেখা যায় অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকেও। সন্ধ্যার পর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক আবারও সুপ্রিমকোর্টে আসেন। সন্ধ্যা ৭টার পর প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন ও সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার আবার তাদের দফতরে আসেন।
সাংবাদিকরা দিনভর সুপ্রিমকোর্টে অবস্থান করেন বহুল আলোচিত এই রায়ের বিস্তারিত জানার জন্য। সন্ধ্যার পরও অনেক সাংবাদিক অপেক্ষায় ছিলেন সুপ্রিমকোর্টে। সবার মধ্যেই কৌতূহল ছিল বিচারপতিরা বিস্তারিত রায়ে কী বলেছেন তা দেখার জন্য।
রায়ে স্বাক্ষর করার পর সুপ্রিমকোর্টে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, যেসব সাইটে রায়টি প্রকাশ করা হয়েছে। আপনারা সেটি দেখে নেবেন।। তত্ত্বাবধায়কের পরিণতি তাহলে কি হলো এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের (বিচারপতিদের) ট্র্যাডিশন হচ্ছে রায় নিয়ে কথা না বলা। কাজে কাজেই আমি কোনো আলাপ করতে পারব না।’ তিনি বলেন, আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির মধ্যে তিনজন আমার সঙ্গে ‘এগ্রি’ করেছেন। বাকি তিনজনের দুইজন ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আরেক বিচারপতি ব্যাপারটি ‘ডিসপোজাল’ করে দিয়ে সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। যারা ভিন্নমত পোষণ করেছেন, তারা আলাদা রায় লিখেছেন। আর যারা আমার সঙ্গে ‘এগ্রি’ করেছেন তারা রায় না লিখলেও আমার লেখা রায়ে তাদের ‘কন্ট্রিবিউশন’ আছে।
‘পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতে এত দীর্ঘ সময় কেন লাগলো’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রায় লিখতে দীর্ঘ সময় লাগেনি। এ রায়ের আগে আমার হাতে আরও ২০টি রায় ছিল। ওই রায়গুলো লেখার পর গত বছরের অক্টোবরে আমি এ রায়টি লেখা শুরু করি। আর গত মার্চে রায় লেখা শেষ হয়। এরপর নানা পরিবর্তন পরিমার্জন করতে গিয়ে কিছু সময় লেগেছে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়ে ১৩তম সংশোধনীকে অসাংবিধানিক, অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে ১৩তম সংশোধনীকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ে তত্ত্বাবধায়কের ব্যাপারটি আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, চূড়ান্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে কোনো নির্দেশনা বা নির্দেশ দেয়া নাই। তত্ত্বাবধায়ক সম্পর্কে কোনো কথাই নেই রায়ে। তাহলে আগে দেয়া সংক্ষিপ্ত রায়ে কেন তত্ত্বাবধায়কের বিষয়টি টেনে আনা হয়ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ‘দুই টার্মের’ জন্য থাকতে পারে বলেছিলেন। তবে এ সরকারের সঙ্গে কোনোভাবেই বিচার বিভাগের কাউকে জড়ানো যাবে না বলেছিলেন তিনি। তবে চূড়ান্ত রায়ের বেলা অন্য তিন বিচারপতি তার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করায় রায়ে এ ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞার ভিন্নমত : প্রধান বিচারপতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা ১৭৮ পৃষ্ঠার অভিমত দিয়েছেন। তার অভিমতে বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ত্রয়োদশ সংশোধনী) সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হলে নিশ্চিতভাবেই দেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। এর ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব পড়বে, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে পেছনে চলতে শুরু করবে। গত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে এই ব্যবস্থা মানুষ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। নির্দলীয় সরকারের অধীনেই তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ষষ্ঠ সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে গণতন্ত্র, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, ক্ষমতা পৃথকীকরণ, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস হয়নি, বরং ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংবিধানিক অপরিহার্যতা। বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা পূর্ণাঙ্গ রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তিনি লিখেছেন, তার পূর্ণাঙ্গ রায় এর আগে দেয়া সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা লিখেছেন, আইনজীবী ড. এম জহির, আজমালুল হোসেন কিউসি, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে স্বাভাবিক লজ্জা বা ন্যাচারাল স্টিগমা বলে উল্লেখ করলেও বাংলাদেশে নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা থাকার কারণে ব্যাপক ভ্রমণকারী এসব বিজ্ঞ আইনজীবীরা দেশে বা বিদেশে কোনো রকম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন কিনা জানতে চাইলে তারা না সূচক জবাব দিয়েছেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন তাদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, বিদেশের অনেকেই তার কাছে নির্দলীয় সরকার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে সংসদ নির্বাচনের ম্যান্ডেট দেয় নাই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভায় তার সহকর্মীরা তো নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তারা তখন একে লজ্জা বলে মন্তব্য করেননি। এমনকি অ্যাটর্নি জেনারেলও একে লজ্জা বলেননি।
প্রকাশিত রায়ের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা পাঠযোগ্য নয় : ৭৪৭ পৃষ্ঠার ওই দীর্ঘ রায়ের বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ার অযোগ্য। ফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার কারণে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রায়ের ৪৩১ ও ৪৩২ পৃষ্ঠার অংশ বিশেষ, ৭২৯ পৃষ্ঠার অংশবিশেষ, ৭৩০ ও ৭৩১ পৃষ্ঠার পুরোটা, ৭৩২ পৃষ্ঠার অংশবিশেষ পড়া যায়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে রায়টি নিয়ে যা ঘটেছে : রায় ঘোষণার ১৩ মাস পর সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে জানিয়েছিলেন, তিনি রায় লিখে আরও তিন মাস আগে জমা দিয়েছেন। জমা দেয়ার পর কেন রায়টি প্রকাশ হচ্ছে না—এ নিয়ে তিনি ওই টেলিভিশন চ্যানেলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তখন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় লিখে জমা দিয়েছেন বলে। এখন আবার তিনি রায়ে স্বাক্ষর করে সুপ্রিমকোর্টে জমা দিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক-উল হক গত আগস্টে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, বিচারপতি খায়রুল হক জমা দেয়া রায়টি আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। বিলম্বের কারণে কৌতূহলী মনে তিনি নিজে খোঁজ নিয়েছিলেন রায়ের বিষয়ে। তাকে সুপ্রিমকোর্টের সংশ্লিষ্ট জায়গা থেকে তখন জানানো হয়, বিচারপতি খায়রুল হক রায় লিখে জমা দেয়ার ক’দিন পর আবার ফেরত নিয়েছিলেন। ফেরত নেয়া রায়ে আবার তিনি স্বাক্ষর করে জমা দিলেন। রায় লিখে একবার জমা দেয়ার পর আবার কেন ফেরত নিয়েছিলেন—এ নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া অবসর গ্রহণের পর কোনো বিচারপতি দীর্ঘদিন ধরে রায় লিখতে পারেন কিনা, এ নিয়েও রয়েছে আইনি বিতর্ক। অবসর গ্রহণের পর বিচারপতিরা আর শপথের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকেন না। শপথের মধ্যে না থাকলে কেউ রায় লিখলে সেটির আইনগত ভিত্তি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান প্রশ্ন তুলে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন গত জুন মাসে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অবসর গ্রহণের আগে তড়িঘড়ি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বৈধ ও গণতান্ত্রিক বলে ঘোষিত হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলটি শুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়। আপিল বিভাগের ডিপ ফ্রিজে থাকা মামলাটি হঠাত্ করেই শুনানির তালিকায় উঠে আসে তখন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সভাপতিত্বে ৭ বিচারপতির সমন্বয়ে আপিল বিভাগের ফুলকোর্টে শুনানি অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের মে মাসে। শুনানিতে সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠতম আইনজীবী সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামসহ সিনিয়র আইনজীবীরা বক্তব্য রাখেন। তাদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পক্ষে আইনি ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা আদালতের সামনে উপস্থাপন করেন। তবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা বিচার বিভাগকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে জড়ানোর বিষয়ে তাদের কারও কারও আপত্তি ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার সঙ্গে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। এমনকি তাদের কেউ কেউ আপিল বিভাগের শুনানিতে বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হলে দেশে রাজনৈতিক বিরোধ চরম আকার ধারণ করবে। এতে যে কোনো সময় রাজনৈতিক প্রলয়ও ঘটে যেতে পারে।
দীর্ঘ শুনানি গ্রহণের পর সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় হয়। ২০১১ সালের ১০ মে রায়ের মূল অংশটি উন্মুক্ত আদালতে ঘোষণা করেন তত্কালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তবে একই বছরের জুন মাসে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মুছে ফেলেছে সরকার। রায়টি ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় ২০১১ সালের ১৭ মে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসরে যান।
তত্ত্বাবধায়কের বিধানটি সংবিধান থেকে উঠিয়ে দিয়ে এখন আওয়ামী লীগ নিজেই বলছে—বিরোধী জোটের অসাংবিধানিক দাবি মানা সম্ভব নয়। সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করবে বলে দাবি করছে আওয়ামী লীগ। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ পালন করেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সংবিধানে আরও একটি বিষয় সংযোজন করেছে। এটি হলো, সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল রেখেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান করা হয় পঞ্চদশ সংশোধনীতে। নতুন করে সংযোজিত বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন মন্ত্রিসভা ও চলমান সংসদ বহাল থাকবে। পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমন বিধান নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের সব দেশেই নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। সংসদ ভেঙে দেয়ার পর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় নির্বাচন।
১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ বিএনপি সরকার সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান করে। এ বিধানের আলোকে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় লাভ করে। তবে এই বিধানটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করেছিলেন একজন আইনজীবী। প্রথমে হাইকোর্ট বিভাগ সরকারের প্রতি কারণ দর্শানোর রুল জারি করে। তিন বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে হাইকোর্ট বিভাগে মামলাটির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের বৃহত্তর বেঞ্চ এক রায়ে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে বলা হয়, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান গণতন্ত্র ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার সহায়ক বলেও হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে উল্লেখ করা হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন রিট আবেদনকারী। দীর্ঘ ক’বছর আপিলটি শুনানির আর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ও আপিলটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল।
সুপ্রিমকোর্টের নিয়ম অনুযায়ী উন্মুক্ত আদালতে আপিল বিভাগের রায়ের মূল অংশটি ঘোষণা করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন বিচারপতি রায় লেখার পর বাকি বিচারপতিদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তখন কারও ভিন্ন কোনো অভিমত বা নতুন কিছু সংযোজন করা প্রয়োজন মনে হলে সেটা করা হয়। পৃথক পৃথকভাবে রায় ঘোষণাকালীন উপস্থিত বিচারপতিদের কাছে রায়ের কপি উপস্থাপনের পর প্রত্যেকে স্বাক্ষর করেন। রায় ঘোষণাকালে উপস্থিত সবার স্বাক্ষরের পরই কেবল তা প্রকাশ করা হয়। এর আগে রায় প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই।
আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার দিন প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে আপিল মঞ্জুর করা হলো। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আইন, ১৯৯৬ (আইন-১ : ১৯৯৬) এখন থেকে বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হলো। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন উল্লিখিত সংশোধনীর অধীনে হতে পারে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের নিয়োগের বিধান বাতিলে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে সংসদের স্বাধীনতা রয়েছে।’