সাহিত্যে নোবেল চীনের মো ইয়েনের | ||
![]() |
নোবেল কমিটি বৃহস্পতিবার বিজয়ী হিসেবে এই সাহিত্যিকের নাম ঘোষণা করে, যিনি চীনের কাফকা হিসেবে পরিচিত। কল্পকথার সঙ্গে ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতার সম্মিলন ঘটেছে মো ইয়েনের লেখনীতে।
পুরস্কারের অর্থমূল্য বাবদ ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার পাবেন এই সাহিত্যিক। আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।
গত বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোয়েমারকে।
চিকিৎসায় নোবেলের জন্য সোমবার দুই স্টেম সেল গবেষক ব্রিটেনের জন বি গার্ডন ও জাপানের শিনিয়া ইয়ামানাকার নাম ঘোষণা করেছে নোবেল কমিটি। এরপর মঙ্গলবার পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারের জন্য ফ্রান্সের সার্জ হ্যারোশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ওয়াইনল্যান্ডের নাম ঘোষণা করা হয়, যারা গবেষণা করেছেন কোয়ান্টাম অপটিকস নিয়ে।
রসায়নে নোবেল পুস্কারের জন্য বুধবার নাম ঘোষণা করা হয় মার্কিন গবেষক রবার্ট জে লেফকোইৎজ ও ব্রায়ান কে কোবিলকার। কোন রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কোষ বাইরের উদ্দীপনায় সাড়া দেয়, গবেষণার মাধ্যমে তা দেখিয়েছেন তারা।
শুক্রবার শান্তিতে ও ১৫ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করবে নোবেল কমিটি।
বাংলাদেশের মন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের এ কেমন আচরণ!

কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক কলম পত্রিকা রোববারের সম্পাদকীয়তে এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। পাঠকদের জন্য সম্পাদকীয়টি হুবহু তুলে ধরা হলো:
“বাংলাদেশ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়া হইতেই ভারতের সহিত এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে দেশটি আবদ্ধ রহিয়াছে। স্বীকার করিতে দ্বিধা নাই, বাংলাদেশ সৃষ্টির ফলে ভারতের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ঝুঁকি বহুলাংশে হ্রাস পাইয়াছে। কারণ, বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়ায় ভারতের পূর্ব প্রান্তে এক বন্ধু রাষ্ট্র স্থাপিত হইয়াছে। ফলে পাকিস্তান অবিভক্ত থাকিলে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতকে যে চাপ বহন করিতে হইত তাহা বহুলাংশে হ্রাস পাইয়াছে। ইহা ব্যতীত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বাংলাদেশে ভারতের পণ্যের বাজার ও বিনিয়োগকেও এক ফলপ্রসূ উপযোগিতা হিসাবে গণ্য করিতে হইবে।
এই রাষ্ট্রটির সহিত আমাদের শুধু প্রতিবেশিসুলভ নহে, ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রাখাও যে বিশেষ জরুরি তাহা উপলব্ধি করিবার জন্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ না হইলেও চলে। ইতা ব্যতীত বাংলাদেশে রহিয়াছে আমাদের বন্ধু রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ। বাংলাদেশে ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাহিরে অবস্থানকালে আওয়ামি লিগের সহিত আমাদের হৃদ্যতা যে সমানভাবে অম্লান রহিয়াছে, ইতিহাস তাহার সাক্ষী। সৌভাগ্য বলিতে হইবে, বর্তমানেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ সরকার শাসন ক্ষমতায় আসীন রহিয়াছে। কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশের সহিত আমাদের সমঝোতা আরও জোরদার হইয়াছে।
কিন্তু কখনও কখনও দেখা যায়, আমাদের নীতি-নির্ধারকদের শালীনতাবর্জিত উপেক্ষামূলক আচরণে এই প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ এবং ক্ষেত্র বিশেষে জনগণ হতবাক হইয়া পড়িতেছেন।
সম্প্রতি ভারতে আসিয়াছিলেন বাংলাদেশের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বলিয়া পরিচিত। তাহার নয়া দিল্লি সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কুমারী শেলজার সহিত দ্বি-পক্ষীয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বৈঠক করা। বাংলাদেশের মন্ত্রী নিশ্চয় আশা করিয়াছিলেন, রাজধানী নয়া দিল্লিতে তাহাকে উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান ও সাদর আপ্যায়ন করা হইবে। কূটনৈতিক দিক দিয়া তো বটেই, ঐতিহ্যবাহী বন্ধুর নিকট এমন প্রত্যাশাই ছিল স্বাভাবিক। বিশেষত, ভারতে মনে করা হয় ‘মেহমান দেব ভবঃ’।
কিন্তু হায়! জনাব আবুল কালাম সাহেবকে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়িতে হয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কুমারী শেলজার সহিত তাহার বৈঠকের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত জায়গার নাম প্রস্তাব করা হয় তাহা যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক। প্রথমে বলা হয়, বাংলাদেশের মাননীয় মন্ত্রীর সহিত বৈঠকটি হইবে একটি হোটেলের লবিতে। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা খানিকটা বিস্ময়ের সহিত প্রস্তবিত বৈঠকস্থল সম্পর্কে মৃদু আপত্তি জ্ঞাপন করেন।
ইহার পর আমাদের ভারতীয় পক্ষ হইতে দুই রাষ্ট্রের মন্ত্রী পর্যায়ের এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের উদ্দেশ্যে যে স্থানটি নির্বাচন করা হয়, তাহা আরও চমকপ্রদ। বলা হয়, বৈঠকটি হইবে হোটেলের ‘বার লাউঞ্জ’ অর্থাৎ কিনা মোহময় শরাবখানায়। সঙ্গত কারণেই হয়তো দ্বিতীয় স্থানটিও বাংলাদেশিরা পসন্দ করিতে পারেন নাই। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই দ্বি-পক্ষীয় মোলাকাত অনুষ্ঠিত হয় ওই হোটেলেরই একটি ডাইনিং হলে। খানাপিনা করার কয়েকটি টেবিল অপসারণ করিয়া লাগসই একটি সোফা সেইখানে স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ দূতাবাস মনঃক্ষুণ্ন হইলেও অগত্যা এইখানেই অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সহিত গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক আলোচনা!
স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠিয়াছে, রাজধানী নয়া দিল্লিতে আন্তর্জাতিক মানের সরকারি ও বেসরকারি ক্ষুদ্র কিংবা বৃহদাকার বহু কনফারেন্স হল থাকিতে কেন হোটেলের লবি, বার এবং শেষে ডাইনিং হলকে বাছিয়া লওয়া হইল? ইহাতে কি এক বৃহৎ ও উন্নত রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাইল? একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশই বা বিষয়টিকে কীভাবে গ্রহণ করিল? এই কথা অবশ্যই বলা যায়, চিন বা পাকিস্তানের সহিত এই ধরনের আচরণ করা হয়তো সম্ভব হইত না।” সূত্র: রেডিও তেহরান।
বই পড়ে স্মরণ করতে হবে হুমায়ূনকে

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের স্মরণসভায় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন, ‘আমার ভাই হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন খেয়ালি মানুষ। জীবন নিয়ে তিনি সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালোবাসতেন, যদিও তাঁর সব নিরীক্ষা ভালো হয়নি।’
জাফর ইকবাল বলেন, ‘তিনি সব সময় বই পড়তেন এবং অন্যদের পড়তে বলতেন। আমাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে ধরে পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য, বই পড়ার প্রতি আমরা যেন মনোযোগী হই। সুতরাং, বই পড়ার মাধ্যমে প্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করতে হবে।’ বই পড়ার মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আজ শুক্রবার সকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব প্রেসক্লাব মিলনায়তনে হুমায়ূন আহমেদ স্মরণসভা উদযাপন পরিষদ ওই স্মরণসভার আয়োজন করে। বড় ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করে এসব কথা বলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
লেখক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা ছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবারের সদস্য। হতদরিদ্র এই পরিবারের সদস্যদের মাটিতে ঘুমাতে হয়েছে। তার পরও হুমায়ূন আহমেদ ও আমরা নীতিবোধ নিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
বিশেষ অতিথি লেখক ও কলামিস্ট আবদুর রউফ বলেন, অনেকে মেধাবী, ভালো লেখক। কিন্তু সবাই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। মানুষের ভালোবাসায় যিনি সিক্ত হতে পারেন, তাঁর মেধা নিয়ে গর্ব করা যায়। হুমায়ূন আহমেদ ওই মাপের একজন মেধাবী লেখক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক এ কে মোবারক আলীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক পৌর মেয়র ফখরুল আলম আক্কাছ, জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ জিতেন্দ্র চন্দ্র দাশ, উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফজলুল হক শাহেদ প্রমুখ।
জাফর ইকবাল বলেন, ‘তিনি সব সময় বই পড়তেন এবং অন্যদের পড়তে বলতেন। আমাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে ধরে পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য, বই পড়ার প্রতি আমরা যেন মনোযোগী হই। সুতরাং, বই পড়ার মাধ্যমে প্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করতে হবে।’ বই পড়ার মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আজ শুক্রবার সকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব প্রেসক্লাব মিলনায়তনে হুমায়ূন আহমেদ স্মরণসভা উদযাপন পরিষদ ওই স্মরণসভার আয়োজন করে। বড় ভাইয়ের স্মৃতিচারণা করে এসব কথা বলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
লেখক জাফর ইকবাল বলেন, ‘আমরা ছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিবারের সদস্য। হতদরিদ্র এই পরিবারের সদস্যদের মাটিতে ঘুমাতে হয়েছে। তার পরও হুমায়ূন আহমেদ ও আমরা নীতিবোধ নিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
বিশেষ অতিথি লেখক ও কলামিস্ট আবদুর রউফ বলেন, অনেকে মেধাবী, ভালো লেখক। কিন্তু সবাই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেন না। মানুষের ভালোবাসায় যিনি সিক্ত হতে পারেন, তাঁর মেধা নিয়ে গর্ব করা যায়। হুমায়ূন আহমেদ ওই মাপের একজন মেধাবী লেখক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক এ কে মোবারক আলীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক পৌর মেয়র ফখরুল আলম আক্কাছ, জিল্লুর রহমান মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ জিতেন্দ্র চন্দ্র দাশ, উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রভাষক ফজলুল হক শাহেদ প্রমুখ।
সময়ের প্রতিবিম্ব
চোরদেরই বলবেন, ‘তুই চোর-তুই চোর’
এবিএম মূসা | তারিখ: ১৩-০৯-২০১২

আমি হুমায়ূন-ভক্ত নই, মানে তাঁর গল্প-উপন্যাস আমাকে তেমন আকৃষ্ট করেনি। তবে টেলিভিশনে তাঁর নাটক দেখার জন্য আমি পাগল ছিলাম। যেখানেই থাকতাম তাঁর নাটক সম্প্রচারের নির্ধারিত সময়ে বাড়িতে হাজির হতাম। হুমায়ূন আহমেদের কোনো একটি নাটকের সংলাপে তিনি যখন টিয়া পাখিকে ‘তুই রাজাকার-তুই রাজাকার’ বুলি শিখিয়ে মাঠে ছেড়ে দিতে বললেন, তখন তাঁর প্রতি আমার মনে অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ জাগে। এরই সূত্র ধরে গত সপ্তাহে বাংলাভিশনে স্নেহাস্পদ গোলাম মোর্তোজা সঞ্চালিত টক শোতে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, শেয়ার মার্কেট আর ডেসটিনির অর্থ আত্মসাৎ এবং আরও অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনায় বলেছি, ‘সরকারের যাকে সামনে পাবেন তাঁকে বলবেন, তুই চোর-তুই চোর’।
তারপর সেই বার্তা ছড়িয়ে গেল সবখানে। শহরে, গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ জনগণের মাঝে ও সরকারি মহলে, হইচই চলছে। কয়েকজন সরকারি কর্মচারী সরকারে ও ওপর মহলে অবস্থানকারী মান্যবর ব্যক্তি, টেলিফোন ও এসএমএসে অনুযোগ করলেন, ‘মূসা ভাই, আমরা যারা সরকারে আছি তারা কি সবাই চোর?’ এই প্রশ্নে আমি বিব্রত হয়েছি। কারণ, টেলিভিশনে মন্তব্যের মধ্যে একটু ফাঁক ছিল, যা টক শোর স্বল্প সময়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। বস্তুত আমি বলতে চেয়েছি, যারা হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালীসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংক থেকে সরকারনিযুক্ত পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের যোগসাজশে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে, শেয়ার মার্কেটে কয়েক লাখ তরুণকে সর্বস্বান্ত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে এবং অন্যান্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরই শুধু দেখা পেলেই বলবেন ‘তুই চোর-তুই চোর’। তা ছাড়া যাঁরা টাকা আত্মসাৎ ও চুরির সুযোগ করে দিয়েছেন অথবা চোরদের বিরুদ্ধে যাঁরা রহস্যমূলক কারণে আজও কোনো ব্যবস্থা নেননি, তাঁদের মুখের ওপর বলতে হবে, ‘তুই-চোর তুই-চোর’। নদীচোর, বালুচোর আর জমিচোরেরা তো রয়েছেনই, শ্রদ্ধেয় বিচারপতি হাবিবুর রহমান এঁদের বলেছেন ‘বাজিকর’। আমি ব্যাংক-চোরদের সরাসরি চোর বলছি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি চোর বলতে শুধু তাঁদের বুঝিয়েছি, নাকি সামগ্রিকভাবে সরকারের সবাইকে বলছি ‘তুই চোর’। আমাদের গাঁয়েগঞ্জে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘মাডিতে বাড়ি মাইরলে গুনাহগার চমকে’। সুতরাং ‘তুই চোর’ বলে যখন একযোগে সবাই চিৎকার দেবেন তখন সরকারের মাঝের সাধু ব্যক্তিদের গা জ্বালা করার কারণ নেই, শুধু চোরেরাই চমকাবে। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা বলতে চাই, আলোচনা প্রসঙ্গে আমার অতি প্রিয়ভাজন অর্থমন্ত্রীর নামটি এসেছে। আমি জানি ও বিশ্বাস করি, মোহিত ভাই অতি সৎ ও সাধু ব্যক্তি, কিন্তু চোরদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা না নেওয়ায় অথবা নিতে অপারগতার কারণেই তিনি সন্দেহ তালিকাভুক্ত হয়েছেন। চুরির দায়ভার তাঁর ওপর কিছুটা হলেও বর্তিয়েছে। কবিগুরুর একটি কবিতার পঙিক্ত হচ্ছে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’। তাই চুরি যিনি করেছেন, চোরের যিনি সহযোগিতা করেছেন, সহ্য করে কোনো আইনি ব্যবস্থা যিনি নেননি, তাঁদের যেখানে যাঁকে পান, বলতে হবে ‘তুই চোর’।
আরও ব্যাখ্যা করছি, আওয়ামী লীগের নামধারী একটি সরকার দেশ চালাচ্ছে আর তাঁদের কারও কারও চুরির অপবাদে নিন্দিত হচ্ছেন দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী। ব্যথিত বেদনার্ত হচ্ছেন প্রকৃত আওয়ামী দরদি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় দল ও সরকার এক নন। অথচ আওয়ামী লীগ দলটিকে আওয়ামী পদবিধারী সরকারের কতিপয় ব্যক্তির কলঙ্কের বোঝা বইতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দলের ‘সভানেত্রীকে’ আওয়ামী নামে পরিচিত সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রীর’ ব্যর্থতার দায় নিতে হচ্ছে। যে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আমি স্নেহ করি, মুজিব ভাইয়ের হাসু আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার বিবেচনায় ভিন্ন ব্যক্তি। প্রথম জনকে আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি ও স্নেহ করি, দ্বিতীয় জনকে সরকার পরিচালনায় কতিপয় ব্যর্থতার জন্য ও অসৎ ব্যক্তিদের রাহুগ্রস্ত হওয়ায় তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্লিপ্ততার জন্য সমালোচনা করি, নিন্দা করি।
আলোচনাটির শুরুতে বলছি সাম্প্রতিক কালে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের এত সমালোচনা করি কেন? কয়েক দিন আগে ‘সুজন’ আয়োজিত একটি সেমিনারে আমার অনুজপ্রতিম বিচারক কাজী এবাদুল হক সরাসরি বললেন, ‘আপনি তো আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, দলটির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তার পরও কেন ইত্যাদি-ইত্যাদি।’ কাজী এবাদুল হককে সেদিন আমি বলেছিলাম, ‘আমি যে আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাংসদ হয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে যে আওয়ামী লীগকে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত “পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায়” দেখেছি, বর্তমানে সেই নামে পরিচয়দানকারী প্রতিষ্ঠান সেটি নয়। এমনকি বর্তমানের আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড মারা সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদের অধিকাংশ ব্যক্তি এবং অতীতের ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে আদর্শের অনুসারী এক নয়, একই চরিত্রের নয়। “বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ” এখনো আমার মনের মাঝে প্রোথিত আছে বলেই আমি সরাসরি দলটির সমালোচনা করি না, দলটির নামের ছাতার ছায়ায় থেকে যাঁরা সরকার গঠন করেছেন, তাঁদের কারও কারও অপকর্মের সমালোচনা করি। দেশের সত্যিকারের আওয়ামী লীগারদের প্রশ্ন করি, বর্তমান সরকারটির দিকে তাকালে সেখানে কয়জন আপনাদের কালে, এমনকি শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে স্থান পাওয়া প্রকৃত আওয়ামী লীগারকে দেখতে পাচ্ছেন? অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন? বর্তমান সরকারে যাঁরা আজ চোর ও বাজিকর দুর্নামে ভূষিত, তাঁরা কি সত্যিই আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী? উত্তর যদি “না” হয়, তবে তাঁরা কারা?’
একটুখানি ব্যাখ্যা করি, সত্তরের নির্বাচনের আগে ন্যাপের মুজাফ্্ফর আহমদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাইনবোর্ড বদলিয়ে আসুন।’ এখন দেখছি সাইনবোর্ড না বদলালেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁদের হাতে দলের নৌকাটি তুলে দিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী করে এনেছেন। এখন তৃণমূল আর বঙ্গবন্ধু-ভাসানী আমলের আওয়ামী লীগাররা বুড়ো আঙুল চুষছেন আর রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে যাঁরা খাল কেটেছেন, বেগম জিয়ার সঙ্গে বিদেশ সফর করেছেন; আওয়ামী লীগ এল কি গেল, মরল কি বাঁচল, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। এ বছর কারও কারও কারণে বিলেতের ইকোনমিস্ট-এর মতে নোংরা রাজনীতির কাদার ছিটা পড়ছে তৃণমূল থেকে পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগার দরদিদের গায়ে। এই কাদা যাঁরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীর গায়ে ছিটিয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই বলতে হবে, ‘তুই চোর-তুই চোর’।
একটু ইতিহাস চর্চা করা যাক। রোজগার্ডেনে ১৯৪৯ সালে আমার কৈশোরকালে যে দলটির জন্ম হয়েছিল, সেটি ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইনের মাধ্যমে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর আইয়ুব খানের ফরমানের বলে সব রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত করার অনুমতি দেওয়া হলো—বৈরুতে চিকিৎসাধীন প্রিয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছার বিপরীতে শেখ মুজিবুর রহমান নতুন আওয়ামী লীগ গঠন করলেন। এ ছিল আমার মতে দলটির জন্মান্তর। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে তাঁর জনপ্রিয়তার ভিত্তির ওপর নতুন করে গঠিত আওয়ামী লীগ সারা দেশে গণজাগরণ ঘটিয়েছে, ছয় দফা আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, নানা প্রতিবন্ধকতা, জেল-জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে যে আওয়ামী লীগ টিকে ছিল, তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্ম দিল, সেটিকে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে নিজেই বিলুপ্ত করে দিলেন। জন্ম দিলেন নতুন দল ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী ও নির্যাতিত জননেতা কেন এই পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন, সেই প্রেক্ষাপট আমার সদ্য প্রকাশিত মুজিব ভাই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে বিস্তারিত বলব।
বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক তিরোধানের পর বিপর্যস্ত ও দিশেহারা দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন ইডেন হোটেল কাউন্সিল সভায় নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগার তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতির অনুসারীরা। আবদুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, আবদুর রাজ্জাক (মরহুম), তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আব্দুল জলিল, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রমুখ বঙ্গবন্ধুসেনারা। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১৫ আগস্টের কয়েক দিন পরই আমি দেশ ছেড়ে চলে যাই। এক বছর পর দেশে ফিরে সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার ফরমান মেনে নিয়ে তাঁর অনুমতিপ্রাপ্ত পুনরুজীবিত আওয়ামী লীগের পতাকাবাহী দলটিকে আমি স্বীকার করে নিয়েছি। কারণটি হচ্ছে, মনের গহনে দলটির প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রোথিত মায়া ও দুর্বলতা বিরাজমান ছিল। আজ সেই দলটিকে যে কয়জন আওয়ামী লেবাস পরে সরকারে অংশ নিয়ে জনগণের কাছ থেকে, তৃণমূলের কর্মীদের আওতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে কলঙ্কিত করছে, আমার লেখায় আর টক শো বক্তব্যে শুধু তাদের নিন্দা করি, দলের কারও নয়। শুধু তাঁদেরই দেখা পেলে বলতে হবে, ‘তুই চোর-তুই চোর’। দলে ও সরকারের স্বল্পসংখ্যক নবাগত, বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী ও সুযোগসন্ধানীর অনেকেই চোর। নৌকাকে যাঁরা দুর্নীতি ও চুরিচামারির লগির খোঁচায় ফুটো করে ডুবিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলবেন ‘তুই চোর-তুই চোর’।
যাঁরা আমার ‘ওই চোর-ওই চোর’ আওয়াজ শুনে মর্মাহত হয়েছেন, তাঁদের একটি কৌতুক উপহার দিচ্ছি। ব্রিটিশ নাট্যকার পরিহাসপ্রিয় বার্নার্ড শকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি অনুষ্ঠানে। তৎকালীন সরকারের কতিপয় ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে শ বললেন, ‘এই সরকারের অর্ধেক লোকই চোর’। অনুষ্ঠানে গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ কেউ শকে অপমানও করলেন। অতঃপর শ তাঁর মন্তব্য ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘এই সরকারের অর্ধেক ব্যক্তিই সাধু’। গুঞ্জন থেমে গেল, সবাই হাততালি দিতে থাকলেন।
আমার নিবন্ধটির সমাপ্তি টানছি ১৯৭২ সালে নিঃস্ব সম্পদহীন নতুন রাষ্ট্রটি পরিচালনায় দিশেহারা বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম জনসভায় দেওয়া ভাষণ উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষে করে রিলিফ আনি, চাটার দল সব চেটে খাচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু যদি বেহেশত থেকে বাংলাদেশের চাটাচাটির বর্তমান রূপটি দেখে থাকেন তবে হয়তো বলছেন, ‘এখন দেখি চাটছে না, গোগ্রাসে গিলছে।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
তারপর সেই বার্তা ছড়িয়ে গেল সবখানে। শহরে, গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ জনগণের মাঝে ও সরকারি মহলে, হইচই চলছে। কয়েকজন সরকারি কর্মচারী সরকারে ও ওপর মহলে অবস্থানকারী মান্যবর ব্যক্তি, টেলিফোন ও এসএমএসে অনুযোগ করলেন, ‘মূসা ভাই, আমরা যারা সরকারে আছি তারা কি সবাই চোর?’ এই প্রশ্নে আমি বিব্রত হয়েছি। কারণ, টেলিভিশনে মন্তব্যের মধ্যে একটু ফাঁক ছিল, যা টক শোর স্বল্প সময়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। বস্তুত আমি বলতে চেয়েছি, যারা হলমার্ক, ডেসটিনি, সোনালীসহ অন্যান্য সরকারি ব্যাংক থেকে সরকারনিযুক্ত পরিচালক ও ব্যবস্থাপকদের যোগসাজশে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে, শেয়ার মার্কেটে কয়েক লাখ তরুণকে সর্বস্বান্ত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছে এবং অন্যান্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরই শুধু দেখা পেলেই বলবেন ‘তুই চোর-তুই চোর’। তা ছাড়া যাঁরা টাকা আত্মসাৎ ও চুরির সুযোগ করে দিয়েছেন অথবা চোরদের বিরুদ্ধে যাঁরা রহস্যমূলক কারণে আজও কোনো ব্যবস্থা নেননি, তাঁদের মুখের ওপর বলতে হবে, ‘তুই-চোর তুই-চোর’। নদীচোর, বালুচোর আর জমিচোরেরা তো রয়েছেনই, শ্রদ্ধেয় বিচারপতি হাবিবুর রহমান এঁদের বলেছেন ‘বাজিকর’। আমি ব্যাংক-চোরদের সরাসরি চোর বলছি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি চোর বলতে শুধু তাঁদের বুঝিয়েছি, নাকি সামগ্রিকভাবে সরকারের সবাইকে বলছি ‘তুই চোর’। আমাদের গাঁয়েগঞ্জে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘মাডিতে বাড়ি মাইরলে গুনাহগার চমকে’। সুতরাং ‘তুই চোর’ বলে যখন একযোগে সবাই চিৎকার দেবেন তখন সরকারের মাঝের সাধু ব্যক্তিদের গা জ্বালা করার কারণ নেই, শুধু চোরেরাই চমকাবে। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা বলতে চাই, আলোচনা প্রসঙ্গে আমার অতি প্রিয়ভাজন অর্থমন্ত্রীর নামটি এসেছে। আমি জানি ও বিশ্বাস করি, মোহিত ভাই অতি সৎ ও সাধু ব্যক্তি, কিন্তু চোরদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা না নেওয়ায় অথবা নিতে অপারগতার কারণেই তিনি সন্দেহ তালিকাভুক্ত হয়েছেন। চুরির দায়ভার তাঁর ওপর কিছুটা হলেও বর্তিয়েছে। কবিগুরুর একটি কবিতার পঙিক্ত হচ্ছে, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে’। তাই চুরি যিনি করেছেন, চোরের যিনি সহযোগিতা করেছেন, সহ্য করে কোনো আইনি ব্যবস্থা যিনি নেননি, তাঁদের যেখানে যাঁকে পান, বলতে হবে ‘তুই চোর’।
আরও ব্যাখ্যা করছি, আওয়ামী লীগের নামধারী একটি সরকার দেশ চালাচ্ছে আর তাঁদের কারও কারও চুরির অপবাদে নিন্দিত হচ্ছেন দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী। ব্যথিত বেদনার্ত হচ্ছেন প্রকৃত আওয়ামী দরদি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞায় দল ও সরকার এক নন। অথচ আওয়ামী লীগ দলটিকে আওয়ামী পদবিধারী সরকারের কতিপয় ব্যক্তির কলঙ্কের বোঝা বইতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দলের ‘সভানেত্রীকে’ আওয়ামী নামে পরিচিত সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রীর’ ব্যর্থতার দায় নিতে হচ্ছে। যে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আমি স্নেহ করি, মুজিব ভাইয়ের হাসু আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার বিবেচনায় ভিন্ন ব্যক্তি। প্রথম জনকে আমি অন্তর থেকে ভালোবাসি ও স্নেহ করি, দ্বিতীয় জনকে সরকার পরিচালনায় কতিপয় ব্যর্থতার জন্য ও অসৎ ব্যক্তিদের রাহুগ্রস্ত হওয়ায় তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে নির্লিপ্ততার জন্য সমালোচনা করি, নিন্দা করি।
আলোচনাটির শুরুতে বলছি সাম্প্রতিক কালে অনেকে প্রশ্ন করেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের এত সমালোচনা করি কেন? কয়েক দিন আগে ‘সুজন’ আয়োজিত একটি সেমিনারে আমার অনুজপ্রতিম বিচারক কাজী এবাদুল হক সরাসরি বললেন, ‘আপনি তো আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন, দলটির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তার পরও কেন ইত্যাদি-ইত্যাদি।’ কাজী এবাদুল হককে সেদিন আমি বলেছিলাম, ‘আমি যে আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাংসদ হয়েছিলাম, পরবর্তী সময়ে যে আওয়ামী লীগকে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত “পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থায়” দেখেছি, বর্তমানে সেই নামে পরিচয়দানকারী প্রতিষ্ঠান সেটি নয়। এমনকি বর্তমানের আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড মারা সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদের অধিকাংশ ব্যক্তি এবং অতীতের ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে আদর্শের অনুসারী এক নয়, একই চরিত্রের নয়। “বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ” এখনো আমার মনের মাঝে প্রোথিত আছে বলেই আমি সরাসরি দলটির সমালোচনা করি না, দলটির নামের ছাতার ছায়ায় থেকে যাঁরা সরকার গঠন করেছেন, তাঁদের কারও কারও অপকর্মের সমালোচনা করি। দেশের সত্যিকারের আওয়ামী লীগারদের প্রশ্ন করি, বর্তমান সরকারটির দিকে তাকালে সেখানে কয়জন আপনাদের কালে, এমনকি শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে স্থান পাওয়া প্রকৃত আওয়ামী লীগারকে দেখতে পাচ্ছেন? অবস্থানে দেখতে পাচ্ছেন? বর্তমান সরকারে যাঁরা আজ চোর ও বাজিকর দুর্নামে ভূষিত, তাঁরা কি সত্যিই আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী? উত্তর যদি “না” হয়, তবে তাঁরা কারা?’
একটুখানি ব্যাখ্যা করি, সত্তরের নির্বাচনের আগে ন্যাপের মুজাফ্্ফর আহমদ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাইনবোর্ড বদলিয়ে আসুন।’ এখন দেখছি সাইনবোর্ড না বদলালেও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁদের হাতে দলের নৌকাটি তুলে দিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী করে এনেছেন। এখন তৃণমূল আর বঙ্গবন্ধু-ভাসানী আমলের আওয়ামী লীগাররা বুড়ো আঙুল চুষছেন আর রাষ্ট্রপতি জিয়ার সঙ্গে যাঁরা খাল কেটেছেন, বেগম জিয়ার সঙ্গে বিদেশ সফর করেছেন; আওয়ামী লীগ এল কি গেল, মরল কি বাঁচল, তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। এ বছর কারও কারও কারণে বিলেতের ইকোনমিস্ট-এর মতে নোংরা রাজনীতির কাদার ছিটা পড়ছে তৃণমূল থেকে পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগার দরদিদের গায়ে। এই কাদা যাঁরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা থেকে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীর গায়ে ছিটিয়েছেন, তাঁদের অবশ্যই বলতে হবে, ‘তুই চোর-তুই চোর’।
একটু ইতিহাস চর্চা করা যাক। রোজগার্ডেনে ১৯৪৯ সালে আমার কৈশোরকালে যে দলটির জন্ম হয়েছিল, সেটি ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইনের মাধ্যমে বাতিল করে দিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর আইয়ুব খানের ফরমানের বলে সব রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত করার অনুমতি দেওয়া হলো—বৈরুতে চিকিৎসাধীন প্রিয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছার বিপরীতে শেখ মুজিবুর রহমান নতুন আওয়ামী লীগ গঠন করলেন। এ ছিল আমার মতে দলটির জন্মান্তর। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে তাঁর জনপ্রিয়তার ভিত্তির ওপর নতুন করে গঠিত আওয়ামী লীগ সারা দেশে গণজাগরণ ঘটিয়েছে, ছয় দফা আন্দোলন করেছে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, নানা প্রতিবন্ধকতা, জেল-জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে যে আওয়ামী লীগ টিকে ছিল, তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের জন্ম দিল, সেটিকে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের মাধ্যমে নিজেই বিলুপ্ত করে দিলেন। জন্ম দিলেন নতুন দল ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী ও নির্যাতিত জননেতা কেন এই পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন, সেই প্রেক্ষাপট আমার সদ্য প্রকাশিত মুজিব ভাই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে বিস্তারিত বলব।
বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক তিরোধানের পর বিপর্যস্ত ও দিশেহারা দলটিকে পুনরুজ্জীবিত করলেন ইডেন হোটেল কাউন্সিল সভায় নিবেদিতপ্রাণ আওয়ামী লীগার তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতির অনুসারীরা। আবদুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, আবদুর রাজ্জাক (মরহুম), তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আব্দুল জলিল, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রমুখ বঙ্গবন্ধুসেনারা। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ১৫ আগস্টের কয়েক দিন পরই আমি দেশ ছেড়ে চলে যাই। এক বছর পর দেশে ফিরে সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার ফরমান মেনে নিয়ে তাঁর অনুমতিপ্রাপ্ত পুনরুজীবিত আওয়ামী লীগের পতাকাবাহী দলটিকে আমি স্বীকার করে নিয়েছি। কারণটি হচ্ছে, মনের গহনে দলটির প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রোথিত মায়া ও দুর্বলতা বিরাজমান ছিল। আজ সেই দলটিকে যে কয়জন আওয়ামী লেবাস পরে সরকারে অংশ নিয়ে জনগণের কাছ থেকে, তৃণমূলের কর্মীদের আওতা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে কলঙ্কিত করছে, আমার লেখায় আর টক শো বক্তব্যে শুধু তাদের নিন্দা করি, দলের কারও নয়। শুধু তাঁদেরই দেখা পেলে বলতে হবে, ‘তুই চোর-তুই চোর’। দলে ও সরকারের স্বল্পসংখ্যক নবাগত, বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী ও সুযোগসন্ধানীর অনেকেই চোর। নৌকাকে যাঁরা দুর্নীতি ও চুরিচামারির লগির খোঁচায় ফুটো করে ডুবিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলবেন ‘তুই চোর-তুই চোর’।
যাঁরা আমার ‘ওই চোর-ওই চোর’ আওয়াজ শুনে মর্মাহত হয়েছেন, তাঁদের একটি কৌতুক উপহার দিচ্ছি। ব্রিটিশ নাট্যকার পরিহাসপ্রিয় বার্নার্ড শকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি অনুষ্ঠানে। তৎকালীন সরকারের কতিপয় ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে দেওয়া বক্তব্যে শ বললেন, ‘এই সরকারের অর্ধেক লোকই চোর’। অনুষ্ঠানে গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ কেউ শকে অপমানও করলেন। অতঃপর শ তাঁর মন্তব্য ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘এই সরকারের অর্ধেক ব্যক্তিই সাধু’। গুঞ্জন থেমে গেল, সবাই হাততালি দিতে থাকলেন।
আমার নিবন্ধটির সমাপ্তি টানছি ১৯৭২ সালে নিঃস্ব সম্পদহীন নতুন রাষ্ট্রটি পরিচালনায় দিশেহারা বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সে স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম জনসভায় দেওয়া ভাষণ উদ্ধৃত করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষে করে রিলিফ আনি, চাটার দল সব চেটে খাচ্ছে।’ বঙ্গবন্ধু যদি বেহেশত থেকে বাংলাদেশের চাটাচাটির বর্তমান রূপটি দেখে থাকেন তবে হয়তো বলছেন, ‘এখন দেখি চাটছে না, গোগ্রাসে গিলছে।’
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments:
Post a Comment