
ফ্লাইট বিপর্যয়, টিকিট সিন্ডিকেট ও সৌদি আরবে বাড়িভাড়াসহ বড় ধরনের বিভিন্ন সমস্যা থেকে রেহাই পেতে অবিলম্বে থার্ড ক্যারিয়ার ওপেন করার জোর দাবি জানিয়েছে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। অন্যথায় বাড়িভাড়ার শিডিউল অনুযায়ী প্রায় ৩০ হাজার হজযাত্রী যথাসময়ে অর্থাত্ প্রথম ১০ দিনের মধ্যে সৌদি আরব যেতে পারবেন না এবং এতে হজ এজেন্সিগুলোর কোটি কোটি টাকা ক্ষতির পাশাপাশি হাজীদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। গতকাল হাব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ আশঙ্কার কথা জানিয়ে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে হাব সভাপতি জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সৌদি সরকারের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে হজযাত্রীদের জন্য বাড়িভাড়া করতে হয় বলে বিমান মন্ত্রণালয়ের হজ ফ্লাইট চূড়ান্ত করার আগেই বাড়িভাড়া করতে বাধ্য হয়েছেন হজ এজেন্টরা। কিন্তু চূড়ান্ত ফ্লাইট শিডিউল পাওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ এজেন্সি যে সময়সীমার জন্য বাসা ভাড়া করেছেন, তাতে হজ ফ্লাইট শুরুর প্রথম দশ দিনের মধ্যে ৬০ হাজারের বেশি হজযাত্রীকে সৌদি আরবে পৌঁছতে হবে।
অথচ সরকার নির্ধারিত বিমান, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স ও নাস এয়ার—এ তিন বিমান পরিবহন সংস্থা যে ফ্লাইটসূচি দিয়েছে, তাতে ওই সময়ের মধ্যে ৩০ হাজার হজযাত্রীকে সৌদি আরবে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এরই মধ্যে বিমানের ফ্লাইট বিপর্যয়ের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রথম ১০ দিন তথা ১৭-২৭ সেপ্টম্বরের মধ্যে ৬০ হাজার হজযাত্রী সৌদি পাঠাতে না পারলে ৩০ হাজার যাত্রীর জন্য নতুন করে বাড়িভাড়া করতে হবে। এতে এজেন্সিগুলোর যেমন অতিরিক্ত কোটি কোটি টাকা গুণতে হবে, তেমনি হাজীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। জামাল উদ্দিন বলেন, বিমানের তেলেসমাতিতে ভরসা না করে সরকার এখনও যদি তৃতীয় কোনো বিমান পরিবহন সংস্থাকে (থার্ড ক্যারিয়ার) হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব দেয়, তাহলেও হয়তো হজযাত্রীদের সময়মতো নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া থার্ড ক্যারিয়ার না থাকায় টিকিট সিন্ডিকেটের কবলে পড়ছে এজেন্সিগুলো। সিন্ডিকেটের চক্রের হাতে টিকিট থাকায় তা চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। এতেও খরচ ও ভোগান্তি বাড়ছে।
এদিকে সম্প্রতি সরকার নতুন করে যে পাঁচ শতাধিক হজ এজেন্সির লাইসেন্স দিয়েছে, তাতে হজ ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে বলে আশঙ্কা করেছেন হাব নেতারা। তিনি বলেন, বর্তমানে ৪০৩টি হজ এজেন্সির মধ্যে ৩৫৪টি এজেন্সি এবার হজযাত্রী পাঠাচ্ছে। অথচ হঠাত্ করে ৫০০ এজেন্সিকে লাইসেন্স দেয়া রহস্যজনক। এই লাইসেন্স দেয়ায় অবশ্যই দুর্নীতি হয়েছে। এতে হজ ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা হবে। তাই এখনই নতুন ৫০০ এজেন্সির লাইসেন্স দেয়া স্থগিত করার দাবি জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, সৌদি আরব সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হজযাত্রী পরিবহন সংক্রান্ত চুক্তি অনুসারে এ বছর কোনো তৃতীয় বিমান সংস্থা বা থার্ড ক্যারিয়ারকে হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। থার্ড ক্যারিয়ার না থাকায় হজযাত্রী পরিবহনে বিশৃঙ্খলা হতে পারে—আগে থেকেই এমন দাবি করে আসছে হজ এজেন্সিগুলো।
নিয়মিত ফ্লাইটসূচিতে বিপর্যয়ের মধ্যেই সোমবার বাংলাদেশ বিমানের হজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে। ভোর ৫টায় ৪১৯ জন হজযাত্রী নিয়ে একটি বোয়িং-৭৭৭ ঢাকা ছাড়ার পর সারাদিনে ছেড়ে গেছে মোট পাঁচটি ফ্লাইট। মন্ত্রণালয়ের ঘোষিত ফ্লাইটসূচি অনুসারে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত হজযাত্রী পরিবহনের কথা রয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থার। বিমান ফিরতি ফ্লাইট শুরু করবে ১ নভেম্বর থেকে, শেষ হবে আগামী ২৯ নভেম্বর। নাস এয়ারের ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ৩০ অক্টোবর, শেষ হবে ২৮ নভেম্বর। সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্স হজ-পরবর্তী ফিরতি ফ্লাইট শুরু করবে ৩০ অক্টোবর এবং শেষ হবে ৩০ নভেম্বর।
এ বছর মোট ১ লাখ ১২ হাজার ৫৬৮ জন হজ করতে যাওয়ার অনুমোদন পেয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাচ্ছেন ২ হাজার ৯৬৫ জন এবং বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় যাচ্ছেন ১ লাখ ৯ হাজার ৬০৩ জন। এর মধ্যে বিমান পরিবহন করছে ৫৬ হাজার ২৮৪ জন।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে হাব মহাসচিব এম এ রশিদ শাহ সম্রাট, নির্বাহী কমিটি সদস্য ফজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রামে ১০ হাজার হজযাত্রীর চরম দুর্ভোগ : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম থেকে হজ ফ্লাইট বাতিলের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন চট্টগ্রামের বিএনপি নেতারা। গতকাল এক বিবৃতিতে নেতারা অবিলম্বে হজ ফ্লাইট চালুর দাবি জানিয়ে বলেন, সরকারের হঠকারি সিদ্ধান্তের কারণে এবছর কোনো হজযাত্রী চট্টগ্রাম থেকে পবিত্র হজে যেতে পারছে না। ফলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রায় ১০ হাজার হজযাত্রী পবিত্র হজ পালনে মারাত্মক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। নেতারা আরও বলেন, শুধু হজ ফ্লাইট নয়, সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতার কারণে ইদানিং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন ফ্লাইট চট্টগ্রাম থেকে বাতিল ও বিমানের সিডিউল পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, অনেক বাংলাদেশী শ্রমিক মারাত্মক সঙ্কটে পড়েছেন। সম্প্রতি ঘোষণা ছাড়া বিমানের সিডিউল পরিবর্তনের কারণে ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা সব হারিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিক্ষোভ ও বিমান অফিসে হামলা চালায়। তারপরও ভয়াবহ এ সঙ্কট উত্তরণে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দেশের সিংহভাগ রেমিট্যান্স মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের কাছ থেকে এলেও তাদের সমস্যা সমাধানে সরকার একেবারেই নিশ্চুপ। অবিলম্বে বিশেষ বিমানযোগে হলেও এসব প্রবাসীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানান।
বিবৃতিদাতারা হলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি সহ-সভাপতি আলহাজ সামশুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, অধ্যাপক শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, আলহাজ ইদ্রিস মিয়া, এনামুল হক, আলহাজ আলমগীর কবির চৌধুরী, আলহাজ আলী আব্বাস।
অবিলম্বে চট্টগ্রাম-জেদ্দা হজ ফ্লাইট চালুর দাবি : চট্টগ্রাম-জেদ্দা সরাসরি বিমান চালুর আশ্বাস দেয়ার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে পরে আবার বাতিল করে দেয়। ফলে চট্টগ্রামের ১০ হাজার হজযাত্রী পবিত্র হজ পালনে যেতে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হবে। কারণ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি জেদ্দা যেতে সময় লাগে মাত্র ৭ ঘণ্টা। সেখানে ঢাকা থেকে যেতে সময় লাগবে ৩৬ থেকে ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত। অবিলম্বে চট্টগ্রাম-জেদ্দা সরাসরি হজ ফ্লাইট চালুর দাবিতে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) ও হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) গতকাল এক যৌথ প্রতিবাদ সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আটাব কার্যালয়ে আটাব চট্টগ্রাম জোন চেয়ারম্যান আলহাজ এমএস আলম-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় বক্তারা বলেন, সরাসরি হজ ফ্লাইট বন্ধ করে বিমান কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। নেতারা এ ব্যাপারে সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেন। অন্যথায় কঠোর কর্মসূচির মাধ্যমে হাজীদের দাবি আদায় করা হবে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের হজ যাত্রীদের নিয়ে যারা অবজ্ঞা আর অবহেলা করে তাদের পরিণতি ভালো হবে না।
সভায় বক্তৃতা করেন হাব চেয়ারম্যান শেখ মুহাম্মদ মুবিনুল হক, আটাব সচিব আলহাজ মো. শাহ আলম, হাব সচিব মোহাম্মদ মোরশেদুল আলম, আলহাজ মো. আবুল কাশেম, আলহাজ মুহাম্মদ আবদুল খালেক, মো. ইয়াছিন, এ.কে.এম.এন. আনোয়ার, আলহাজ এইচএম মুজিবুল হক শুক্কুর, মো. নজরুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, মো. নুরুল আমিন, মো. এনামুল ইসলাম, ফারুক আহমদ শাহীন, বখতেয়ারুল ইসলাম চৌধুরী, এসএম শহিদুল্লাহ, মো. লুত্ফুর রহমান, শহীদুল হক, নুরুল আবছার দুলাল, মাহফুজুর রহমান ও মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরী প্রমুখ।
বিমানের ফ্লাইট সূচি বিপর্যয় চলবে সোমবার পর্যন্ত : এদিকে বিডিনিউজ জানায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সূচি বিপর্যয় আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর সোমবার পর্যন্ত চলবে বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ভাড়ায় আনা একটি বোয়িং ৭৪৭ উড়োজাহাজ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ১২ সেপ্টেম্বর চলে যাওয়ায় নিয়মিত ফ্লাইট সূচি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এ প্রতিষ্ঠানটি। এরপর এই প্রথম এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিলো বিমান।
গতকাল রাজধানীর কুর্মিটোলায় বিমান সদর দফতর বলাকায় বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ শাহ নেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই একটি ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজ চলে যাওয়ার কারণে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য বিমান কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছে। আমরা পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছি। তবে ২৪ সেপ্টেম্বরের আগে তা সম্ভব হবে না।
তিনি জানান, এ বছর শুধু হজযাত্রী পরিবহনে একটি ভাড়ায় আনা বোয়িং ৭৪৭, দুটি নিজস্ব বোয়িং ৭৭৭ এবং একটি ডিসি ১০ উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো দিয়ে কোনো নিয়মিত যাত্রী বহন করা হচ্ছে না। সুতরাং প্রভাব পড়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
অবশ্য শাহ নেওয়াজের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য এবং এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম। তিনি বলেন, সিডিউল অপারেশন বাদ দিয়ে চার্টার অপারেশন করার নজির বিশ্বের কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। অনেক সঙ্কট সত্ত্বেও দেশের মানুষের কাছে বিমানের একটি আলাদা কদর ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এ ঘটনার কারণে বিমান তা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ফ্লাইট সূচি বিপর্যয়ের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের যাত্রীদের ভোগান্তি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ফ্লাইট সূচি সামলাতে আটটি নিয়মিত ফ্লাইটের বিলম্ব হয়েছে। সরেজমিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা যায়, ফ্লাইট বিলম্ব হওয়ায় অপেক্ষা করছেন কয়েকশ’ যাত্রী। এদের অনেকেই অভিযোগ করেন, ২/১ দিনের মধ্যে যেতে না পারলে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে তাদের।