ঘটনাটি একেবারেই নাটকীয়। কেউ কেউ বলছেন, মেলোড্রামা, অতি নাটকীয়। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্ব গ্রহণে রাজি হলেন না। 'বিনয়ের' সঙ্গে বললেন, মন্ত্রী হতে চাই না, দলের জন্য কাজ করতে চাই। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও মন্ত্রী হতে শেষ পর্যন্ত সম্মত হলেন না। তার প্রত্যাখ্যানের প্রেক্ষাপট অবশ্য ভিন্ন। মন্ত্রী হতে ব্যক্তিগতভাবে তিনি মোটেই অনাগ্রহী ছিলেন না। বুধবার রাতে তার সঙ্গে কথা বলে সমকালের মনে হয়েছিল মেনন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে প্রস্তুত। তার ইচ্ছায় বাদ সাধলো তার দলের পলিটব্যুরো। মেননের সভাপতিত্বে সভা করে ওয়ার্কার্স পার্টি পলিটব্যুরো জানিয়ে দিল, সরকারের সময় প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, এখন আর মন্ত্রিত্ব নয়। একটি সংবাদ সংস্থা এই দুই প্রবীণ রাজনৈতিক নেতার মন্ত্রী হওয়ার অনিচ্ছাকে সুন্দর শিরোনাম দিয়েছে 'উপেক্ষার জবাব প্রত্যাখ্যানে'।বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান গতকাল দুপুরে স্বয়ং তোফায়েল আহমেদকে টেলিফোনে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবে রাজি হতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি এ অনুরোধে সাড়া দেননি।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তোফায়েলকে তিনি টেলিফোন করেননি বলে জানিয়েছেন। তবে রীতি অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ সচিবই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করেন। তোফায়েল আহমেদের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। বুধবার গভীর রাতে সমকাল যোগাযোগ করলে তোফায়েল আহমেদ জানান, তিনি মনস্থির করতে পারেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা টেলিফোন করলে তোফায়েল আহমেদ দুপুর ১টা পর্যন্ত সময় নেন। তবে এ সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই মন্ত্রী হতে তার অপারগতার কথা তিনি সাংবাদিকদের জানান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সমকালকে বলেছেন, তোফায়েল আহমেদের মতো
একজন প্রবীণ নেতা ও ক্ষুরধার পার্লামেন্টারিয়ানকে প্রায় ৪ বছর মন্ত্রিত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রাখা এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে সুবিবেচনার কাজ হয়নি। সঙ্গত কারণেই তোফায়েলের মনে ক্ষোভ জমেছিল। ওয়ান ইলেভেনের সময় তার ভূমিকা নিয়ে হাইকমান্ডে নানা প্রশ্ন রয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের চেয়ে এ মুহূর্তে জরুরি ছিল অদক্ষ ও নানা অভিযোগে অভিযুক্ত মন্ত্রীদের সরিয়ে দেওয়া। রাষ্ট্রপতির অনুরোধেও তোফায়েল আহমেদ সাড়া না দেওয়ায় অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা এ ঘটনাকে স্বাভাবিক মনে করছেন না।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তোফায়েল আহমেদের মন্ত্রী না হওয়াসহ প্রাসঙ্গিক বিষয় জানতে চান। এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'আমি তাকে (তোফায়েল আহমেদ) টেলিফোন করিনি। আমি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। আমার টেলিফোন প্রত্যাখ্যান করলে তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয় আসত। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হওয়ার জন্য ক্যাবিনেট বিভাগ থেকে অনেককে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যারা রাজি হয়েছেন তারা শপথ নিয়েছেন। তাছাড়া আমি সাতজনকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী করতে চেয়েছিলাম। সাতজনই মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন।'
তোফায়েলের বক্তব্য
তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আমাদের বর্তমান মন্ত্রিসভার সদস্যরা সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রী একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি সব সময় পরিশ্রম করছেন। সঠিকভাবে সরকার পরিচালনা করছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কাজ করি। আমি আওয়ামী লীগের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। এখানে ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই।' তিনি বলেন, 'যারা এখন মন্ত্রী আছেন বাকি দিনগুলোতে তারাই ভালো করে কাজ করতে পারবেন। নতুন যারা যোগ দিয়েছেন, তারাই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। আমার মতো একজন তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিসভায় যোগদান না করলে তাতে কিছুই যায় আসে না। সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগ সফল হলেই হলো। আমি আওয়ামী লীগকে ভালোবাসি।' তবে তোফায়েল আহমেদের এ বক্তব্য ও মনের কথার মধ্যে কতখানি মিল রয়েছে তা নিয়ে অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে।
মন্ত্রী না হওয়ার সিদ্ধান্ত বিরোধী দলকে সমালোচনার সুযোগ করে দিতে পারে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিরোধী দল তো সব বিষয়েই সুযোগ নিতে চায়। এ আর নতুন কী। কোনো ধরনের হতাশা থেকে এ সিদ্ধান্ত কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার মধ্যে কোনো ক্ষোভও নেই। হতাশাও নেই।'
আ'লীগের দু'নেতার ভিন্নমত
তোফায়েল আহমেদের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেননি আওয়ামী লীগে তার দুই সহকর্মী সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী ও কাজী জাফর উল্লাহ। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, তোফায়েল আহমেদকে মন্ত্রিসভায় নিতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানে সাড়া দেননি। কেন তিনি মন্ত্রী হননি, সেটা তিনিই বলতে পারেন।
কাজী জাফর উল্লাহ বলেছেন, 'কমিউনিকেশন গ্যাপে'র কারণেই এমন অপ্রিয় ঘটনা ঘটেছে। ক্যাবিনেট সচিবের আগে তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বললে এ অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটত না। তবে মন্ত্রী না হওয়ার ব্যাপারে তোফায়েল আহমেদের সিদ্ধান্তে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এই দুই নেতার জায়গায় দু'জন সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূতকে মন্ত্রী করায় অবাক হয়েছেন কাজী জাফর উল্লাহ।
নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া
তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তারা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছেন, কী কারণে তোফায়েল আহমেদ মন্ত্রী হলেন না। এর কোনো সদুত্তর মেলেনি। এ অবস্থায় তোফায়েল আহমেদের সিদ্ধান্তকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন দলের নেতাকর্মীরা। তোফায়েল আহমেদ ওয়ান ইলেভেনের সময় নেতিবাচক পরিস্থিতিতে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর নেতাকর্মীদের একাংশ এ বিষয়টিকেই আলোচনার পুরোভাগে নিয়ে এসেছেন।
রাজনীতির হিসাব-নিকাশ রাখেন এ রকম কয়েকজন নতুন করে আরও নাটকীয় ঘটনা দেখার অপেক্ষায় থাকার কথা বলেছেন।
ওয়ার্কার্স পার্টির বক্তব্য
রাশেদ খান মেননের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তোপখানা রোডের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর জরুরি বৈঠক বসে। চার ঘণ্টার এ বৈঠকে মেননের মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব গ্রহণ না করার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে যোগ দেন দলের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান মলি্লক, পলিটব্যুরো সদস্য বিমল বিশ্বাস, নূরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদ, ফজলে হোসেন বাদশা, নূর আহমদ বকুল, ইকবাল কবির জাহিদ ও কামরুল আহসান। তবে সরকারে যোগ না দিলেও ওয়ার্কার্স পার্টি সংসদ এবং সংসদের বাইরে সক্রিয় থেকে ১৪ দল ও মহাজোটকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভূমিকা রাখবে বলে অঙ্গীকার করা হয়েছে।
এ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের রাশেদ খান মেনন জানান, মন্ত্রী হিসেবে তার শপথ না নেওয়ার বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দিয়েছে দলের পলিটব্যুরো। তিনি এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
No comments:
Post a Comment