Sunday, October 7, 2012

বিচারপতি মানিককে নিয়ে স্পিকারের রুলিং বিতর্ক : সরকার আপিলের অনুমতি পায়নি

বিতর্কিত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে নিয়ে স্পিকারের রুলিং বেআইনি, অসাংবিধানিক ও ভিত্তিহীন বলে হাইকোর্টের ঘোষিত রায়ের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের দায়ের করা লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করেনি আপিল বিভাগ। আপিলের অনুমতি না দিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণসহ সরকারপক্ষের দায়ের করা আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দিয়েছে আপিল বিভাগ। দুই পক্ষের শুনানি শেষে গতকাল প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ফুলকোর্ট ‘অর্ডার ইজ ডিসপোজাল উইথ সাম অবজারভেশন’ বলে রায় ঘোষণা করেন। ফলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি মিলল না সরকারের। আপিল বিভাগের নিয়মানুযায়ী পূর্ণাঙ্গ আদেশ পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করা হয়। আইনজ্ঞরা বলছেন, রায় প্রকাশ হওয়ার পর বোঝা যাবে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে কী পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। রায় প্রকাশ হওয়ার আগে পর্যবেক্ষণ জানার কোনো সুযোগ নেই। গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে শুনানি শেষে রোববার আদেশের জন্য ধার্য করা হয়েছিল। এদিন আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় শীর্ষে ছিল মামলাটি। সকালে বিচারপতিরা এজলাসে বসার পর আইনজীবীরা বিভিন্ন মামলা উপস্থাপন করেন। এরপর প্রধান বিচারপতি একবাক্যে এ মামলার আদেশ দেন।
আদেশের পর এক প্রতিক্রিয়ায় রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার আখতার ইমাম বলেন, এ রায়ের ফলে হাইকোর্টের আদেশই বহাল রইল। আপিলের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় হাইকোর্টের আদেশ পরিবর্তন করার আর তেমন সুযোগ নেই বলে আমার মনে হয়। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ে বেশকিছু আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। শুনানিতে আমরা সেগুলোর ব্যাপারে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আদালত আমাদের ‘অ্যাপ্রিসিয়েট’ করে। আশা করি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সব বিতর্কের অবসান হবে। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হবে। হাইকোর্টের মূল রিটের বেলায়ও প্রথমে পর্যবেক্ষণসহ সংক্ষিপ্ত আদেশ দেয়া হয়েছিল। পরে পর্যবেক্ষণের বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়।
ব্যারিস্টার আখতার ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের করা আপিল গ্রহণ করা হলে এ নিয়ে বিতর্ক আরও বাড়ত। রাষ্ট্রের প্রধান দুটি ‘অর্গানের’ মধ্যে যেন সংঘাতের সৃষ্টি না হয় সে জন্য আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়েছে। ফলে হাইকোর্টের দেয়া আদেশই বহাল রইল।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, আসলে এ বিষয়টি আদালতে নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। রায়ের কোনো কোনো অংশে আমরা ক্ষুব্ধ, কোনো কোনো অংশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য নষ্ট করবে তা আমরা আদালতকে বলেছি।
তিনি বলেন, স্পিকার সংসদের প্রধান। তিনি যা বলেন, সংসদে তাই বাস্তবায়িত হয়। হাইকোর্টের রায়ে তার বিরুদ্ধে কোনো কটূক্তি থাকলে নিশ্চয়ই আপিল বিভাগ বিষয়টি বিবেচনা করবে।
প্রধান অ্যাটর্নি বলেন, লিভ টু আপিল আবেদন মঞ্জুর না করেও অতীতে বহু রায় পরিবর্তন করেছে আপিল বিভাগ। আমাদের আবেদনে কয়েকটি বিষয়ে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আশা করি এমন কিছু করা হবে না, যাতে এ দুটি অঙ্গের মধ্যে বিতর্ক বাড়ে। আমাদের আবেদনটি খারিজ করা হয়নি কিছু পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেয়া হয়েছে।
গত ২৩ জুলাই হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিনকে নিয়ে স্পিকারের দেয়া রুলিংয়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদন করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এটিএম সাইফুদ্দীন। ২৪ জুলাই বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এবিএম আলতাফ হোসেন সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কিছু পর্যবেক্ষণসহ রিট আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেন। ২৭ আগস্ট পর্যবেক্ষণসহ পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশ করা হয়। এর আগে ২২ জুলাই হাইকোর্টের আরেকটি দ্বৈত বেঞ্চ এ রিটের শুনানিতে বিব্রতবোধ করেছিল।
হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ আদেশে বলা হয়, বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীকে নিয়ে স্পিকারের রুলিংয়ের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই এবং তা আইনের দৃষ্টিতে অস্থিত্বহীন। স্পিকারের রুলিং সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
এ বছরের ১৪ মে সড়ক ভবন নিয়ে আদালত অবমাননা মামলায় বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ একটি আদেশ দেন। এ নিয়ে ২৯ মে সংসদে আলোচনা চলাকালে স্পিকার আবদুল হামিদ কথা প্রসঙ্গে ‘জনগণ ক্ষুব্ধ হলে বিচার বিভাগের প্রতি রুখে দাঁড়াতে পারে’ বলে মন্তব্য করেন।
এরপর ৫ জুন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ স্পিকার আবদুল হামিদের দেয়া বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বলে মন্তব্য করেন। স্পিকারকে নিয়ে আদালতে কটাক্ষমূলক মন্তব্য করেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। ওই দিন সন্ধ্যায় সংসদে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনা ও অপসারণ দাবি করেন সরকারদলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য। তারা বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মস্তিষ্ক বিকারগ্রস্ত বলে মন্তব্য করেন। এ জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করতে তিন দিনের আল্টিমেটাম দেয়া হয় জাতীয় সংসদে। পরে ১৮ জুন এ বিষয়ে স্পিকার রুলিং দেন। স্পিকারের রুলিংয়ে বলা হয়, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের ভার প্রধান বিচারপতির ওপর ন্যস্ত করেন স্পিকার।

No comments:

Post a Comment