Thursday, September 20, 2012

‘রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’

undefined

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আজ বৃহস্পতিবার বলেছেন, সাবেক বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসর গ্রহণের আগে এবং পরে পৃথক রায় দিয়ে বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অস্পষ্ট এবং অগ্রহণযোগ্য হিসেবেও অভিহিত করেছেন।

আজ বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বেগম জিয়া এ মন্তব্য করেন। রোববার সুপ্রিম কোর্ট ওই রায় প্রকাশ করে।
বিরোধী দল বলে আসছে, ওই রায়ে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে।
খালেদা জিয়া আগেই জানিয়েছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ছাড়া তার দল নির্বাচনে যাবে না।
রায় সম্পর্কে খালেদা জিয়া আরো বলেন, এই রায় নৈতিকতাবিরোধী। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে এই রায় দেয়া হয়েছে। এটি দেশের রাজনৈতিক সংকট আরো বাড়াবে। জাতিকে এর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে দলীয়করণের দৃষ্টান্ত দেখতে হলো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এ রায় তাই জনগণ মেনে নেবে না।
তিনি অভিযোগ করেন, সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সঙ্গে স্পষ্টতই অসঙ্গতিপূর্ণ। মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতির এমন পপাতদুষ্ট আচরণ একটি মারাত্মক বিচারিক অসদাচারণ।
তিনি বলেন, এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শুধু নয়, গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৮ দলের অবস্থানও তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আর এ গনি, টি এইচ খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, নজরুল ইসলাম খানসহ বিএনপির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এখানে খালেদা জিয়ার লিখিত বক্তব্য পুরোটা তুলে ধরা হলো-
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আপনারা জানেন যে, ১৯৯৬ সালের আগে দেশের সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল না। ১৯৯৫ সাল থেকে বর্তমানে মতাসীন আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামসহ কতিপয় রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সহিংস আন্দোলন শুরু করে। তারা দিনের পর দিন হরতাল করেছে, যানবাহন ও সম্পদের বিপুল তি সাধন করেছে, নীরিহ মানুষের জীবন নাশ করেছে, সংসদ বর্জন করেছে এবং শেষ পর্যন্ত এই দাবিতে জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছে। তাদের সেই পদত্যাগের ফলে জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে সংবিধান সংশোধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্র“য়ারি জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান করি। এই বিধানের অধীনে ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো পুনরায় আন্দোলনের নামে সহিংসতা শুরু করে। ক্রমাগত হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচি, অবরোধ এবং শেষ পর্যন্ত লগি-বৈঠা আন্দোলনে প্রকাশ্য রাজপথে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটিয়ে তারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এরই সুযোগে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারীর আবরণে দেশে চলমান গণতন্ত্র ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ছদ্মাবরণে সেনা সমর্থিত এক অসংবিধানিক সরকার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এই অসংবিধানিক সরকারকে তাদের আন্দোলনের ফসল বলে ঘোষণা দেন এবং তাদের সকল অপকর্মকে আগাম বৈধতা প্রদান করেন। দীর্ঘ ২ বছর ধরে সেই সরকার দেশকে রাজনীতিহীন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন করার অপচেষ্টা চালায়। তাদের অপশাসনে অতিষ্ঠ জনগণের আন্দোলনের মুখে তারা জরুরী অবস্থা বহাল রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। আমরা জরুরি অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তারা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ সেই অবৈধ সরকারের সকল অপকর্মের বৈধতা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের সাথে অশুভ আঁতাত করে এবং জরুরী অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে যেতে রাজি হয়। তাদের এই আঁতাত বুঝতে পেরেও জনগণকে তাদের হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া এবং অনির্বাচিত স্বৈরশাসন থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য আমরা নির্বাচনে অংশ নেই। নীল নকশার সেই নির্বাচনে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের সহায়তায় ব্যাপক কারচুপি সম্পর্কে আপনারা সবাই অবহিত আছেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কখনো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা বলেনি। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারেও এ সম্পর্কে কোনো কথা নেই। এমন কি সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে গঠিত সংসদীয় কমিটিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। একইভাবে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণী-পেশার সংগঠন, সংবিধান বিশেষজ্ঞগণও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পে মত দিয়েছেন।
এরপর সরকার তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় নির্বাচনে অবধারিত পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে মত পাল্টিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা শুরু করে।
অন্যদিকে সেই সময় নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি জনাব এ বি এম খায়রুল হক হঠাৎ করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে বহু আগের এক রীট মামলা হতে উদ্ভুত আপিল শুনানীর জন্য গ্রহণ করেন। বিষয়টি সাংবিধানিকভাবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আদালতের বন্ধু হিসাবে যে ৮ জন সিনিয়র আইনজীবিকে মতামত দিতে ডাকা হয়েছিল তাদের ৭ জনই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সাথে অসংগতিপূর্ণ নয় বলে মত দেন। এতদসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি জনাব এ বিএম খায়রুল হক গত বছর ১৭ মে তারিখে অবসরে যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১০ মে তারিখে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে এক সংপ্তি রায় ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি বিভক্ত রায়। তিনি প্রকাশ্য আদালতে যে সংপ্তি ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন তার সাথে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পরে গত কয়েকদিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচারণ। আমরা তার এই আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আমরা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষন করে বলতে চাই যে Ñ
ক। বিচারকগণ পপাতহীন থেকে সুবিচার করার যে প্রতিশ্র“তি ঘোষণা করে বিচারক হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন- অবসরে যাওয়ার পর তারা সেই শপথের অধীন থাকেন না। আর সে কারণেই অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি আদালতে বসতে পারেন না, শুনানী করতে পারেন না এবং একই কারণে কোন মামলার রায়ও লিখতে কিংবা তাতে দস্তখত করতে পারেন না। কিন্তু বিচারপতি খায়রুল হক তাই করেছেন। ফলে এই রায় যৌক্তিক কারণেই পপাতদুষ্ট, অগ্রহণযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।
খ। ১০ মে, ২০১১ তারিখে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত রায়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, ১৯৯৬ ভাবিসাপেে (চৎড়ংঢ়বপঃরাবষু) বাতিল ও মতা বহির্ভূত ঘোষণা করে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন যেÑ
“জাতীয় সংসদের দশম ও একাদশ নির্বাচন অনাদিকাল থেকে চলে আসা নীতির ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিধানসমূহের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, যা অন্যবিধভাবে বৈধ নয়Ñ প্রয়োজনের কারণে বৈধ; জনগণের নিরাপত্তার জন্যÑযা সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যÑ যা সর্বোচ্চ আইন।”
ঐ রায়ে আরো বলা হয়েছিলÑ
“যা হোক, ইতিমধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপীল বিভাগের কোন বিচারপতিকে নিয়োগ দানের বিধানটি বাদ দেয়ার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার েেত্র জাতীয় সংসদ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।”
অথচ, সম্প্রতি প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তারই ঘোষিত রায় থেকে সরে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেছেন।
প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত সংপ্তি রায় এবং পরবর্তী পর্যায়ে ঘোষিত লিখিত রায়ে এমন গরমিল নজিরবিহীন। এ ঘটনা যে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই ঘটানো হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেনÑতা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের হুবহু প্রতিধ্বনি এবং তাদের পূর্ববর্তী রায়ের সাথে স্পষ্টত:ই অসঙ্গতিপূর্ণ। মাননীয় সাবেক প্রধান বিচারপতির এমন পপাতদুষ্ট আচরণ একটি মারাত্মক বিচারিক অসদাচারণ।
এই মন্দ দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শুধু নয় - গোটা দেশ ও দেশের জনগণকে হেয় করবে।
গ। বিচারপতি আঃ ওয়াহাব মিয়া সাবেক প্রধান বিচারপতির লেখা রায়ের সাথে ১০ মে ২০১১ তারিখে ঘোষিত রায়ের অসঙ্গতির কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে আলাদা রায় দিয়েছেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিচারপতি আঃ ওয়াহাব মিয়ার সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করেছেন। একই সাথে তারা ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সাংবিধানিকভাবে অপরিহার্য্য এবং সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক নয় বলেও মত দিয়েছেন।
একই মত দিয়েছেন বিচারপতি ইমান আলীও। তিনি আরো বলেছেন যে, এই রায়ের ফলে দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি টেলিভিশনে দেয়া এক সাাৎকারে বলেছিলেন যে তিনি ২৯ মার্চ, ২০১২ তারিখে তার লেখা রায় সই করে জমা দিয়েছেন।
গত রবিবার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন যে, জমাকৃত রায়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জনের জন্য তিনি সেই রায় ফেরত নিয়ে কয়েক মাস পরে আবার জমা দিয়েছেন। অর্থাৎ একই রায় তিনি ২ বার লিখেছেন এবং ২ বার দস্তখত করেছেন। মতাসীন সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী লেখার জন্যই যে তিনি নিজের লেখা রায় ফিরিয়ে এনে পুনরায় লিখেছেন তা সুষ্পষ্ট হয়েছে নতুন রায়ে সরকারি অবস্থানের পে লেখা বিভিন্ন প্রস্তাবে।
তার এই আচরণ একেবারেই বিচারক সুলভ নয়Ñ বরং নৈতিকতা বিরোধী। ফলে অনিবার্য্যভাবেই এই রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে - যার জবাব দেয়ার নৈতিক দায়িত্ব সাবেক প্রধান বিচারপতির।
প্রবীন আইনজীবি ব্যারিস্টার রফিকুল হক তার এই পরিবর্তন - পরিমার্জনের বিষয়টিকে বিশ্রীরকম ভুল ও অসদাচারন বলে বর্ণনা করেছেন।
বার কাউন্সিলের নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রবীন আইনজীবি এ্যাড. খন্দকার মাহবুব হোসেন একে সরাসরি প্রতারণা বলেছেন।
ঘ। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মূল কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যেÑ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না। অথচ ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, মতাসীন সরকারই সংপ্তিাকারে নতুন নির্বাচিত সরকারের মতাগ্রহণ করা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। যদিও রায়ের অন্য অংশে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সংসদ বহাল না থাকলে কেউই নির্বাচিত থাকেন না।
তাহলে ঐ ৪২ দিন-অর্থাৎ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে, নির্বাচনের সময় এবং নতুন সরকার মতা গ্রহণ করা পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন কোন যুক্তিতে ? এটি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের স্ববিরোধিতার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি।
উল্লেখযোগ্য যে, ১০ মে ২০১১ তারিখে যখন সংপ্তি রায় ঘোষণা করা হয় তখন জাতীয় সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করার বিধান রেখেছে। সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে নির্বাচনের পূর্ববর্তী ৪২ দিনের উল্লেখ স্পষ্টত:ই সরকারি ইচ্ছার সাথে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। আদালতের রায়কে রাজনীতিকরণের এ এক চরম নিন্দনীয় দৃষ্টান্ত।
মতাসীন সরকারের ইচ্ছা পূরণের জন্যই যে এসব পরস্পর বিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আমরা মনে করি যে নৈতিকতা বিরোধী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত এই রায় যৌক্তিক কারণেই অকার্যকর। এই রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। ১৯৭৫ সালে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় বিচার বিভাগকে প্রশাসনের অধীন করা হয়েছিল। আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তা থেকে বিচার বিভাগকে মুক্ত করেছিলেন।
দেশের জনগণ বিচার বিভাগকে দলীয় প্রভাবমুক্ত এক নিরপে প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখতে চায়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা সুবিচার থেকে বঞ্চিত ও আশাহত হয়েছে।
আমরা ঘোষণা করছি যে, সাবেক প্রধান বিচারপতির দেয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, অযৌক্তিক ও পরস্পর বিরোধী রায় জনগণ কখনো গ্রহণ করবে না এবং তার ভিত্তিতে আয়োজিত কোনো নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করবে না।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
১০ মে ২০১১ ঘোষিত সংপ্তি রায়ে উল্লেখিত “প্রয়োজনের কারণে বৈধ এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থ-যা সর্বোচ্চ আইন”-তা রার কোন তাগিদ মতাসীন সরকার অনুভব করেনি।
প্রধান বিরোধী দলসহ দেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দল-এমন কি মতাসীন মহাজোটের অংশীদার কয়েকটি দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক সমাজ এবং দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তীব্র আপত্তি তারা গ্রাহ্য করেনি।
তারা স্বৈরতান্ত্রিক বাকশাল কায়েমের মতো দ্রুততার সাথে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকার এবং বর্তমান সংসদ বহাল রেখে তার অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অগণতান্ত্রিক আইন পাশ করেছে।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে পুনরায় রাষ্ট্র মতা দখলের সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন চলছে এবং ক্রমান্বয়েই তা তীব্রতর হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে বর্তমান সরকারকে তাদের অনৈতিক ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হিসাবে নতুন করে লেখা এই রায় উপহার দেয়া হলো।
একই সাথে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী অপ্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও এই রায়ে অবৈধ ফখরুদ্দিন সরকারকে বৈধতা দেয়া হয়েছে Ñ যা এই রায়কে রাজনীতিকরণের আর একটি দৃষ্টান্ত। জাতির দুর্ভাগ্য যে, দলীয় স্বার্থে বিচার বিভাগকে ব্যবহারের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তাদের প্রত্য করতে হলো।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
মতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের কোন নির্বাচনী প্রতিশ্র“তিই আজ পর্যন্ত পুরণ করতে পারেনি। দ্রব্য মূল্যের অব্যাহত ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ দিশেহারা, গ্যাস-বিদ্যুত পানির অভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত। আইন-শৃঙ্খলার এতই অবনতি ঘটেছে যে, মানুষ ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। ইলিয়াস আলী ও চৌধুরী আলমসহ গুম হওয়া কারও কোন সন্ধান নেই।
সাংবাদিক সাগর-রুনি দম্পতিসহ কোন খুনেরই সুরাহা হচ্ছে না। সীমান্তে প্রতিদিন দেশের মানুষ খুন হচ্ছে, অবাধে চোরাচালান চলতে থাকায় দেশের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে। সরকার ও সরকারি দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনিু পর্যায় পর্যন্ত প্রায় সকলেই দুর্নীতি ও অনাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। এই সরকার আগের মেয়াদে দেশকে দুর্নীতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। এবারও তাদের দুর্নীতি দেশের সীমা পেরিয়ে বিদেশেও বি¯তৃত হয়েছে।
আজ আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি দুর্নীতির অভিযোগে কলংকিত। জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সরকার গদি রায় ব্যস্ত। এই অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। জনগণ এই দুরাবস্থা থেকে মুক্তি চায়। তারা জুলুম, নিপীড়ন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অবসান চায়। সরকার উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের সকল প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে অকার্যকর করে ফেলেছে। কোন প্রতিষ্ঠানের উপরই আজ আর জনগণের আস্থা নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি লাভের জন্যই আমরা অবাধ ও নিরপে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছি। আর এমন নির্বাচন কেবল নির্দলীয় - নিরপে সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হতে পারে। কাজেই নির্দলীয় - নিরপে সরকারের অধীনেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত জনগণের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। অবসরপ্রাপ্ত কোন সাবেক প্রধান বিচারপতির পপাত দুষ্ট রায় এই আন্দোলনকে দুর্বল কিংবা ব্যাহত করতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সংসদে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা জনগণকে বিভ্রান্ত করার আর একটি অপচেষ্টা মাত্র। তিনি প্রকৃতপে মতায় অধিষ্ঠিত থেকেই একটি সাজানো নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করছেন। এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার।
জনগণের ভোটাধিকার রার জন্য নির্দলীয়, নিরপে সরকারের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ কোন অবস্থাতেই দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো নির্বাচন মেনে নেবে না।
আমরা বিশ্বাস করি, রাজনৈতিক বিষয়ে জনগণই সকল মতার উৎস।
জনগণের আন্দোলন কখনো ব্যর্থ হয়নি - এবারও হবে না ইন্শাআল্লাহ।
আপনাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আল্লাহ হাফেজ, বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।’

No comments:

Post a Comment