বহু জল ঘোলা হওয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে ফিরে এসেছে বিশ্ব ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের এই খবর জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি “বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাইকা এডিবিসহ অন্য দাতাদের সবাইকে এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে তারা।”
দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ঋণচুক্তি বাতিল করা বিশ্ব ব্যাংককে এই প্রকল্পে ফেরাতে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব ব্যাংক দুই পক্ষই ‘ছাড়’ দিচ্ছে বলে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দুপুরেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন।
রাষ্ট্রদূত আশা করছেন, বৃহস্পতিবার রাতেই বিশ্ব ব্যাংক এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে; দুর্নীতির অভিযোগ তুলে যারা আড়াই মাস আগে বাংলাদেশের বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করেছিল।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন স্থগিতের পর কয়েকটি শর্ত দেয় সংস্থাটি, যা পূরণ হয়নি জানিয়ে ঋণচুক্তি বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
বিশ্ব ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তে সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হলেও পরে এই প্রকল্পে তাদের ফেরাতে সরকারের চেষ্টা চলতে থাকে।
এর অংশ হিসেবে পদত্যাগ করেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, ছুটিতে যান সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। প্রকল্পের ইন্টেগ্রিটি অ্যাডভাইজর মসিউর রহমানের ছুটিতে যাওয়ার খবরও সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, যদিও তিনি তা অস্বীকার করে আসছেন।
বিশ্ব ব্যাংকের দেয়া চার শর্তের শেষ শর্ত (মসিউরের ছুটিতে যাওয়া) নিয়ে ওয়াশিংটনে আলোচনা হওয়ার পর পদ্মা সেতু প্রকল্পে বহুজাতিক দাতা সংস্থাটির ফিরে আসার পথ তৈরি হয়েছে বলে ঢাকায় জল্পনা চলছিল।
এর মধ্যে ওয়াশিংটনে যান প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, যিনি ওয়াশিংটনে সংস্থার সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টেইন এখন ওয়াশিংটনে রয়েছেন এবং সমঝোতার আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।
রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের বলেন, “আজ (বৃহস্পতিবার) সকালেও গওহর রিজভী সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আজকেও বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক আছে তার।”
দুপুরে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিশ্ব ব্যাংকের ঘোষণা আসছে ‘যে কোনো মুহূর্তে’। সমঝোতার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাংককেও কিছু ‘ছাড়’ দিতে হয়েছে।
মসিউর রহমানের ছুটির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, “পদ্মা সেতুসহ সরকারের কোনো আর্থিক বিষয়ে মসিউর রহমানের কোনো সম্পৃক্ততা থাকবে না।”
বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পদ্মা সেতু তৈরিতে গত বছরের প্রথমার্ধে বিশ্ব ব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার সঙ্গে ঋণচুক্তি করে সরকার। ২৯১ কোটি ডলারে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিতল রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণের নকশা হয়। শুরু হয় জমি অধিগ্রহণও।
কিন্তু প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য প্রাথমিক যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কানাডার এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে ওই দেশের পুলিশ দুর্নীতির অভিযোগ তুললে বিশ্ব ব্যাংক তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ার কথা জানিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি স্থগিত করে।
বিশ্ব ব্যাংক প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও শুরু থেকে সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। প্রকল্পে সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগ/ছুটিতে পাঠানো এবং তদন্তের শর্ত বিশ্ব ব্যাংক দিলেও সরকারের কার্যক্রমে তা পূরণের কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি, যদিও কাজ আটকে যায় প্রকল্পের।
কোনো শর্ত পালন হয়নি জানিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিলে সরকারপ্রধানসহ সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। বিশ্ব ব্যাংককে আক্রমণ করে বক্তব্যও আসে।
বিশ্ব ব্যাংককে বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায়ও হয়। অন্যদিকে বিশ্ব ব্যাংক চুক্তি স্থগিতের পর মালয়শিয়ার সঙ্গেও এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যায় সরকার।
তার মধ্যে আবার বিশ্ব ব্যাংককে ফেরানোর আলোচনাও চলে, যার সফলতা শুরু থেকেই আশা করে আসছিলেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।
বিশ্ব ব্যাংকের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসছে- জানিয়ে দুপুরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বহুজাতিক এ দাতা সংস্থা চুক্তি বাতিল করায় দেশের সুনাম যেটুকু ‘ক্ষুন্ন’ হয়েছিল, তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করায় তা আবার ‘সমুন্নত’ হয়েছে।
“দুর্নীতির অপবাদ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংক ঋণ চুক্তি বাতিল করেছিল। আমরা তাদের সে অপবাদ প্রত্যাখ্যান করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বলেছিলাম,” বলেন তিনি।
পদ্মা প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন বাতিল করলে অন্য ঋণদাতা এডিবির ৬১ কোটি ৫০ লাখ, জাইকার ৪০ কোটি এবং আইডিবি ১৪ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতিও আটকে যায়।
তবে সরকারের অনুরোধে এডিবি ও জাইকা তাদের ঋণচুক্তির মেয়াদ দুই দফা বাড়ায়। আইডিবি অবশ্য প্রকল্পে থাকার সিদ্ধান্ত জানায়। |
|
No comments:
Post a Comment