Wednesday, September 19, 2012

সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন : পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে সরে এসে পার্লামেন্টে শেখ হাসিনার ঘোষণা


আগামী সংসদ নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগের অবস্থান থেকে সরে এসে জানালেন, সংসদ বহাল রেখে নয়, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন হবে। গতকাল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সংসদ রেখে তো নির্বাচন হবে না। আমরা ওয়েস্টমিনিস্টার টাইপ অব গভর্নমেন্ট অনুসরণ করি। এ পদ্ধতিতে সরকারপ্রধান রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের প্রস্তাব দেন। সে অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্দেশ দেন এবং নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ আরও ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেমন আমি রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে অনুরোধ করব, আমরা ওই তারিখে, সময়ে নির্বাচন করতে চাই। তখন রাষ্ট্রপতি ঠিক করবেন সংসদ করে ডিজল্ভ (ভেঙে দেয়া) হবে। এই মন্ত্রিসভা থাকবে, না কি ছোট করতে হবে, কতজন থাকবে—এই নির্দেশ তিনি (রাষ্ট্রপতি) দেবেন। এটা সম্পূর্ণ তার এখতিয়ার। এর পর রাষ্ট্রপতি যেভাবে নির্দেশ দেবেন, সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নির্বাচন করবে।’
গতকাল জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ের পর এ নিয়ে যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল বিতর্ক চলছে এবং বিরোধীদলীয় নেতা আজ এ নিয়ে বিরোধী জোটের অবস্থান তুলে ধরার জন্য সংবাদ সম্মেলনের আহ্বান করেছেন, ঠিক তখন প্রধানমন্ত্রী নতুন এ ঘোষণা দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে সদ্যঘোষিত আপিল বিভাগের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের মতামতের অনেকটাই মিল রয়েছে। তবে রায় অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দিলে নির্বাচিতদের দিয়ে কীভাবে সরকার হবে; আবার প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে নির্বাচনের দিন, তারিখ, সময় নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারাধীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ হবে কি না, সেসব বিতর্ক নতুন করে শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রধামন্ত্রীর গতকালের বক্তব্য পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে সরে আসা এবং ষষ্ঠদশ সংশোধনীর ইঙ্গিত কি না, সে প্রশ্নও উঠতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী গতকাল সংসদে আরও বলেন, আমরা জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করি। যে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষার জন্য আমরা দিনের পর দিন আন্দোলন করেছি, সংগ্রাম করেছি, জেল খেটেছি, সেই জনগণের ভোট কেড়ে নেয়া বা চুরি করা আমাদের রীতি নয়। আমরা ভোট চুরির রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা তা করবও না। তাই জনগণ চাইলে আমরা আছি, আর না চাইলে নাই। এটা পরিষ্কার কথা। এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বর্তমান সরকারের আমলে সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে টক শো’তে গিয়ে টেলিভিশন ফাটিয়ে ফেলেন, তাদের বলতে চাই, বাংলাদেশের ইতিহাসে পঁচাত্তরের পর দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকতে এত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত নেই।
বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি প্রসঙ্গে ইমাজউদ্দিন প্রামাণিকের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যে কোনো ধরনের কথা বা দাবি করার স্বাধীনতা সবার রয়েছে। তবে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করছেন, তারা যাদি অতীত অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যান, আমার কিছু বলার নেই। যদি ১/১১-এর মতো সরকার ক্ষমতায় আসে, সংবিধান কার্যকর থাকবে না। ইয়াজউদ্দীন, যদি ফখরুদ্দীন ও মইনউদ্দিনের মতো সরকার একটার পর একটা আসতেই থাকে, তারাও গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবেন। অবশ্য যারা সে সময় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তাদের কথা আলাদা।
এর আগে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইমাজউদ্দিন প্রামাণিকের লিখিত প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের অধীনে যে কোনো ধরনের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার মতো গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে ফিরে এসেছে। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেন বাদ হয়। আমরা জনগণের সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে এটা বাতিল করেছি।
ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটচুরির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন পরিচালনায় ও ক্ষমতায় থাকার যে দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে, সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জনগণের মনে শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। আবার যদি এ ব্যবস্থা আসে, আর যদি ক্ষমতা না ছাড়ে, তাহলে জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার হারাবে।
তিনি বলেন, মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর উপ-নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন, পৌরসভার নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে। জনগণ পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পেরেছে—যা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিচায়ক।
সংসদ নেতা বলেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সব সময় রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান রয়েছে বিধায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু নেই। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে।
সংসদের পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, সংসদে সর্বদলীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক সংবিধান সংশোধন করে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গ : পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের কাছে দুটো জিজাইন আছে। আমরা দুটোই খতিয়ে দেখছি। মাঝখানে রেললাইন দিয়ে দু’পাশে সড়ক সেতু করতে খরচ অনেক কম পড়বে। আমাদের সেটা করার আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আমরা টাকা সাশ্রয় করেছি। তার মাধ্যমে এটা আমরা করতে পারব। তাছাড়া আমাদের যে রিজার্ভ রয়েছে, সেখান থেকে ১-২ বিলিয়ন ডলার খরচ করা কঠিন কাজ হবে না। এছাড়া দেশবাসী ও প্রবাসীদের পক্ষ থেকে আমরা যে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি, তাতে আমাদের আত্মবিশ্বাস জন্মেছে, এই সেতু আমরা করতে পারব। কোনো সারচার্জ বসাতে হবে না। কোনো সারচার্জ ছাড়াই এই সেতু কীভাবে করা যায়, আমরা তার উদ্যোগ নিয়েছি। ইনশাআল্লাহ আমরা এ সেতু করতে পারব।
এ সময় পদ্মা সেতু অর্থায়ন বন্ধের পেছনে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের হাত রয়েছে—এমন ইঙ্গিত দিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক নিজেই এগিয়ে আসে। এরপর দুর্নীতির গন্ধ পেয়ে তারা অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। মাননীয় সংসদ সদস্য, মঙ্গলবার যার জন্য সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন, তার কিছু কারসাজি ছিল বলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করেছে।

No comments:

Post a Comment