অসহনীয় গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিং রাজধানীর বাইরে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি সবচেয়ে নাজুক
শুক্রবার টঙ্গী আত-তাকওয়া জামে মসজিদের আসর ও মাগরিব নামাজের আজান এলাকাবাসী শোনেনি। মাইক ছাড়াই আজান দিতে হয়েছে। কারণ বিদ্যুত্ ছিল না। আইপিএস ছিল, কিন্তু জুমার সময় বিদ্যুত্ না থাকায় দীর্ঘ সময় আইপিএস চালাতে গিয়ে সেটিও অচল হয়ে গেছে। নতুন ব্যাটারি কিনতে হবে ২০ হাজার টাকার অধিক মূল্যে। মসজিদের ইমাম এ নিয়ে ছোটাছুটি করছেন কমিটির সভাপতিসহ অন্যদের কাছে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ডেসকোর আওতাভুক্ত টঙ্গীতে চিত্র ছিল এরকম। শুক্র ও শনিবার দিনে-রাতে ওই এলাকায় ৮ থেকে ১০ বার লোডশেডিং করা হয়েছে। এ হচ্ছে নগরচিত্র।
আর গ্রামে? চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের অধিবাসী সারওয়ার আলম জানান, প্রতিদিনই সেখানে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, যখন তখন বিদ্যুত্ চলে যাচ্ছে। একনাগাড়ে ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্তও বিদ্যুত্হীন থাকার ঘটনাও ঘটছে। সারওয়ার আলম আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, তিনি সকালে এক ঘণ্টা ও বিকালে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার জন্য বিদ্যুত্ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। লোডশেডিংয়ের কষ্টের কথা যাতে ভুলে না যায় সে জন্যই নাকি প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশ কি শহরের জন্য না গ্রামের জন্য তা আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ আমাদের তো দিন-রাতের অধিকাংশ সময় লোডশেডিংয়ের অসহনীয় কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের ব্যাপকতা না কমলেও বিদ্যুত্ বিলের পরিমাণ বেড়েই চলছে। বিদ্যুত্ না থাকার পরও কেন অতিরিক্ত বিল দিতে হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।
গত দু’দিন ধরে দেশে অসহনীয় গরম পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং। রাজধানীর বাইরে সারাদেশে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি টঙ্গী ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এলাকার মতোই। উচ্চমূল্যের জ্বালানি তেলনির্ভর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রের তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার ফলে বিদ্যুত্ উত্পাদন কমে এসেছে বলে মনে করেন বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে তেল সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়েই এখন তেল সরবরাহ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য তেল আমদানি শতকরা ২২ ভাগ কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ের লোডশেডিং প্রসঙ্গে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া, বাতি যাবে নিভিয়া।’ এই হচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর অবস্থা। সরকার গত সাড়ে তিন বছরে পিডিবির আওতাভুক্ত দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অতিমাত্রায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এসব বিদ্যুেকন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে তেল সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি দিতে হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সরকার এসব বিদ্যুেকন্দ্রে তেল সরবরাহ করলে বিদ্যুত্ পাবে। আর তেল সরবরাহ করতে না পারলে বিদ্যুেকন্দ্রগুলোকে উল্টো জরিমানা দেবে। তারা বলেন, এসব বিদ্যুেকন্দ্রের ওপর সরকারের অতিমাত্রার নির্ভরশীলতার কারণে বিদ্যুত্ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে ও ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগসহ নানা উপায়ে মানুষের পকেট কেটেও এসব বিদ্যুেকন্দ্র বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে করে লোডশেডিং আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
সরকারি হিসাবেও উত্পাদন কমেছে : বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দেয়া তথ্য মতে গত ৫ সেপ্টেম্বর পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৯ মেগাওয়াট। অথচ ৫ দিন আগে গত ৩১ আগস্ট পিক আওয়ারে ৬ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হয়েছে বলে পিডিবিরই ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও পিডিবির এ হিসাবে তাদের নিজেদেরই আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। পিডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রায়ই টাকা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ও গ্রাহকদের মোবাইলে মেসেজ দিয়ে বলি, আজ দেশে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে ততটুকু বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে। অর্থাত্ দেশের কোথাও লোডশেডিং হয়নি। তিনি বলেন, পিডিবির দেয়া এ তথ্য যখন আমি মোবাইলে পড়ছিলাম, তখন আমার এলাকায়ও বিদ্যুত্ ছিল না। যদিও আমরা এটাকে কারিগরি ত্রুটি বলে চালিয়ে দিচ্ছি। প্রকৃত অর্থে দেশে এখন দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
পিডিবির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিপিসি থেকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রেগুলোর জন্য পিডিবিকে চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া এসব বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ভর্তুকিজনিত লোকসানের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পখাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রমজান মাসকে সামনে রেখে ভাড়াভিত্তিক যেসব বিদ্যুেকন্দ্র পুরোদমে চালানো হয়েছিল, সেগুলো এখন ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। এসব কারণেই লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে বলে জানান তিনি।
গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ : ৫-৬ দফা দাম বৃদ্ধি ও বিলে ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে গত সাড়ে তিন বছরে বিদ্যুতের দাম তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যে গ্রাহক আগে বিদ্যুত্ বিল দিতেন ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। এখন ওই গ্রাহক একই পরিমাণ বিদ্যুত্ ব্যবহার করে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বিল পরিশোধ করছেন। এর ওপর আবার চলছে অসহনীয় লোডশেডিং। গত দু’দিন ধরে তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে লোডশেডিং। এ নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজধানীতে দিনে ৪-৫ বার বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করলেও গ্রামাঞ্চলের অবস্থা খুবই করুণ বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের অসহনীয় যন্ত্রণার শিকার গোলাপবাগ এলাকার গৃহবধূ রহিমা বেগম টেলিফোনে আমার দেশ-কে জানান, রোজার মাস থেকে শুরু করে মাঝখানে কয়েকদিন বিদ্যুত্ পরিস্থিতি ভালোই ছিল। তবে এখন অবস্থা সেই ৬ মাস আগের মতোই। প্রধানমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা প্রতিদিনই হাজার হাজার মেগাওয়াটের হিসাব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীও কিছুদিন আগে বলেছেন, দিনে দুই ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকবে না, বিদ্যুত্ না থাকার কষ্ট বোঝার জন্য। এখন দেখি গরমের মধ্যে ৭-৮ ঘণ্টাই কষ্ট করতে হয়।
রাজধানীর বংশাল এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল মতিন জানান, যদি কষ্টই করতে হয় তাহলে আমরা কেন তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুত্ কিনছি। বিদ্যুত্ দিতে পারছে না, অথচ কয়েকদিন পরপরই নানা বাহানা দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এখন ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিল ডাবল করে দেয়া হয়েছে। সরকার মূলত আমাদের জনগণের সঙ্গে তামাশা শুরু করে দিয়েছে। এগুলো স্রেফ ফাজলামো ছাড়া আর কিছুই না- এই বলে ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি।
কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা শামসুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৫-৬ বার লোডশেডিং হয়। একবার বিদ্যুত্ চলে গেলে এক ঘণ্টা পর বিদ্যুত্ আসার কথা থাকলেও বিদ্যুত্ আসে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পরে। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারেও লোডশেডিং হয়েছে কয়েক দফায়। বিদ্যুত্ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চালু করায় এলাকায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক শব্দদূষণ।
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের সারওয়ার আলম আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন- সাধারণ মানুষ যাতে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণার কথা ভুলে না যায় সেজন্য প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়া হবে। তার অর্থ হচ্ছে, এখন আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণে দৈনিক ২ ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। যদি প্রধানমন্ত্রীর এ ইচ্ছা পূরণের জন্য শুধু ২ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো তাতে আমরা বরং খুশিই হতাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের এলাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকে না। কখনো কখনো লাগাতার ১৫ ঘন্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয় আমাদের এলাকায়। তিনি বলেন, সরকার একদিকে নানা অজুহাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। আবার ঠিকমত বিদ্যুত্ও দিচ্ছে না।
লোডশেডিং আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা : লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও তীব্র হবে বলে মনে করছেন বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, লোডশেডিং আরও বাড়বে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ সাড়ে তিন বছর আগে বিদ্যুত্ খাত নিয়ে সরকারের গ্রহণ করা পরিকল্পনা সঠিক ছিল না। ওই সময় অনেক ভাড়াভিত্তিক জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। স্থায়ী পরিকল্পনা নেয়ার পরিবর্তে এসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ওপর সরকার অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রগুলো সব সময় চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। অপরদিকে দীর্ঘমেয়াদি যেসব বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার কোনোটাই আগামী তিন থেকে চার বছরের আগে আসবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও বিদ্যুত্ বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেছেন, সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতির ফসল হচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল। শুধু রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের কারণেই বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে সরকারকে ৩৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এরমধ্যে কমপক্ষে ২৮ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। তিনি বলেন, অবৈধ ও বেআইনিভাবে গড়ে উঠা এসব বিদ্যুেকন্দ্রের অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই পরিত্যক্ত ও পুরনো। এগুলোর কোনোটাই শতভাগ চালানোর মতো নয়। ফলে যে বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে একশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হওয়ার কথা সেটা এখন ত্রিশ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।
রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের জ্বালানি ব্যয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্যাসভিত্তিক একটি বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুত্ উত্পাদন খরচ পড়ে ১ টাকা সত্তর পয়সা থেকে দুই টাকার মতো। অথচ তেলভিত্তিক একটি কেন্দ্রের মাধ্যমে সেই বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ পড়ে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। কাজেই জনগণের পকেট কেটে নিয়েও এ ভর্তুকি পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে এসব বিদ্যুেকন্দ্রের অবস্থা হচ্ছে, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া, বাতি যাবে নিভিয়া’র মতো অবস্থা। এসব কারণে সামনের দিনগুলোতে লোডশেডিং আরও তীব্র হবে বলে মনে করেন তিনি।
আর গ্রামে? চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের অধিবাসী সারওয়ার আলম জানান, প্রতিদিনই সেখানে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, যখন তখন বিদ্যুত্ চলে যাচ্ছে। একনাগাড়ে ৬ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্তও বিদ্যুত্হীন থাকার ঘটনাও ঘটছে। সারওয়ার আলম আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, তিনি সকালে এক ঘণ্টা ও বিকালে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার জন্য বিদ্যুত্ বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন। লোডশেডিংয়ের কষ্টের কথা যাতে ভুলে না যায় সে জন্যই নাকি প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ। প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশ কি শহরের জন্য না গ্রামের জন্য তা আমরা বুঝতে পারছি না। কারণ আমাদের তো দিন-রাতের অধিকাংশ সময় লোডশেডিংয়ের অসহনীয় কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের ব্যাপকতা না কমলেও বিদ্যুত্ বিলের পরিমাণ বেড়েই চলছে। বিদ্যুত্ না থাকার পরও কেন অতিরিক্ত বিল দিতে হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না।
গত দু’দিন ধরে দেশে অসহনীয় গরম পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত লোডশেডিং। রাজধানীর বাইরে সারাদেশে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি টঙ্গী ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ এলাকার মতোই। উচ্চমূল্যের জ্বালানি তেলনির্ভর রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রের তেল সরবরাহ কমিয়ে দেয়ার ফলে বিদ্যুত্ উত্পাদন কমে এসেছে বলে মনে করেন বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুত্ কেন্দ্রগুলোতে তেল সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়েই এখন তেল সরবরাহ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। বিদ্যুত্ কেন্দ্রের জন্য তেল আমদানি শতকরা ২২ ভাগ কমিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ের লোডশেডিং প্রসঙ্গে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া, বাতি যাবে নিভিয়া।’ এই হচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর অবস্থা। সরকার গত সাড়ে তিন বছরে পিডিবির আওতাভুক্ত দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুেকন্দ্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার না করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অতিমাত্রায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছে। এসব বিদ্যুেকন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে তেল সরবরাহ করতে গিয়ে সরকারকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি দিতে হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সরকার এসব বিদ্যুেকন্দ্রে তেল সরবরাহ করলে বিদ্যুত্ পাবে। আর তেল সরবরাহ করতে না পারলে বিদ্যুেকন্দ্রগুলোকে উল্টো জরিমানা দেবে। তারা বলেন, এসব বিদ্যুেকন্দ্রের ওপর সরকারের অতিমাত্রার নির্ভরশীলতার কারণে বিদ্যুত্ খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে বাধ্য। দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে ও ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগসহ নানা উপায়ে মানুষের পকেট কেটেও এসব বিদ্যুেকন্দ্র বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। এতে করে লোডশেডিং আরও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
সরকারি হিসাবেও উত্পাদন কমেছে : বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দেয়া তথ্য মতে গত ৫ সেপ্টেম্বর পিক আওয়ারে বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৯ মেগাওয়াট। অথচ ৫ দিন আগে গত ৩১ আগস্ট পিক আওয়ারে ৬ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন করা হয়েছে বলে পিডিবিরই ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও পিডিবির এ হিসাবে তাদের নিজেদেরই আস্থা নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা। পিডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা প্রায়ই টাকা খরচ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ও গ্রাহকদের মোবাইলে মেসেজ দিয়ে বলি, আজ দেশে যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে ততটুকু বিদ্যুত্ উত্পাদন হয়েছে। অর্থাত্ দেশের কোথাও লোডশেডিং হয়নি। তিনি বলেন, পিডিবির দেয়া এ তথ্য যখন আমি মোবাইলে পড়ছিলাম, তখন আমার এলাকায়ও বিদ্যুত্ ছিল না। যদিও আমরা এটাকে কারিগরি ত্রুটি বলে চালিয়ে দিচ্ছি। প্রকৃত অর্থে দেশে এখন দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত্ ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
পিডিবির ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিপিসি থেকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রেগুলোর জন্য পিডিবিকে চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ করতে অপারগতা প্রকাশ করা হয়েছে। তাছাড়া এসব বিদ্যুেকন্দ্রের জন্য ভর্তুকিজনিত লোকসানের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পখাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়াও রমজান মাসকে সামনে রেখে ভাড়াভিত্তিক যেসব বিদ্যুেকন্দ্র পুরোদমে চালানো হয়েছিল, সেগুলো এখন ঠিকভাবে চালানো যাচ্ছে না। এসব কারণেই লোডশেডিং কিছুটা বেড়েছে বলে জানান তিনি।
গ্রাহকদের মধ্যে ক্ষোভ : ৫-৬ দফা দাম বৃদ্ধি ও বিলে ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে গত সাড়ে তিন বছরে বিদ্যুতের দাম তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যে গ্রাহক আগে বিদ্যুত্ বিল দিতেন ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। এখন ওই গ্রাহক একই পরিমাণ বিদ্যুত্ ব্যবহার করে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা বিল পরিশোধ করছেন। এর ওপর আবার চলছে অসহনীয় লোডশেডিং। গত দু’দিন ধরে তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে লোডশেডিং। এ নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজধানীতে দিনে ৪-৫ বার বিদ্যুত্ আসা-যাওয়া করলেও গ্রামাঞ্চলের অবস্থা খুবই করুণ বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের অসহনীয় যন্ত্রণার শিকার গোলাপবাগ এলাকার গৃহবধূ রহিমা বেগম টেলিফোনে আমার দেশ-কে জানান, রোজার মাস থেকে শুরু করে মাঝখানে কয়েকদিন বিদ্যুত্ পরিস্থিতি ভালোই ছিল। তবে এখন অবস্থা সেই ৬ মাস আগের মতোই। প্রধানমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা প্রতিদিনই হাজার হাজার মেগাওয়াটের হিসাব দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীও কিছুদিন আগে বলেছেন, দিনে দুই ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকবে না, বিদ্যুত্ না থাকার কষ্ট বোঝার জন্য। এখন দেখি গরমের মধ্যে ৭-৮ ঘণ্টাই কষ্ট করতে হয়।
রাজধানীর বংশাল এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল মতিন জানান, যদি কষ্টই করতে হয় তাহলে আমরা কেন তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুত্ কিনছি। বিদ্যুত্ দিতে পারছে না, অথচ কয়েকদিন পরপরই নানা বাহানা দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এখন ধাপ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিল ডাবল করে দেয়া হয়েছে। সরকার মূলত আমাদের জনগণের সঙ্গে তামাশা শুরু করে দিয়েছে। এগুলো স্রেফ ফাজলামো ছাড়া আর কিছুই না- এই বলে ক্ষোভ ঝাড়েন তিনি।
কাঁঠালবাগান এলাকার বাসিন্দা শামসুল ইসলাম জানান, প্রতিদিন কমপক্ষে ৫-৬ বার লোডশেডিং হয়। একবার বিদ্যুত্ চলে গেলে এক ঘণ্টা পর বিদ্যুত্ আসার কথা থাকলেও বিদ্যুত্ আসে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পরে। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবারেও লোডশেডিং হয়েছে কয়েক দফায়। বিদ্যুত্ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চালু করায় এলাকায় সৃষ্টি হয় ব্যাপক শব্দদূষণ।
চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের সারওয়ার আলম আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন- সাধারণ মানুষ যাতে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণার কথা ভুলে না যায় সেজন্য প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে লোডশেডিং দেয়া হবে। তার অর্থ হচ্ছে, এখন আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণে দৈনিক ২ ঘণ্টা লোডশেডিং হবে। যদি প্রধানমন্ত্রীর এ ইচ্ছা পূরণের জন্য শুধু ২ ঘণ্টা লোডশেডিং হতো তাতে আমরা বরং খুশিই হতাম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের এলাকায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুত্ থাকে না। কখনো কখনো লাগাতার ১৫ ঘন্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয় আমাদের এলাকায়। তিনি বলেন, সরকার একদিকে নানা অজুহাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। আবার ঠিকমত বিদ্যুত্ও দিচ্ছে না।
লোডশেডিং আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা : লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরও তীব্র হবে বলে মনে করছেন বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুত্ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, লোডশেডিং আরও বাড়বে, এতে সন্দেহ নেই। কারণ সাড়ে তিন বছর আগে বিদ্যুত্ খাত নিয়ে সরকারের গ্রহণ করা পরিকল্পনা সঠিক ছিল না। ওই সময় অনেক ভাড়াভিত্তিক জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুেকন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। স্থায়ী পরিকল্পনা নেয়ার পরিবর্তে এসব রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ওপর সরকার অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর্থিক সঙ্কটের কারণে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্রগুলো সব সময় চালিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। অপরদিকে দীর্ঘমেয়াদি যেসব বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তার কোনোটাই আগামী তিন থেকে চার বছরের আগে আসবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক ও বিদ্যুত্ বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেছেন, সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতির ফসল হচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল। শুধু রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের কারণেই বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতে সরকারকে ৩৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এরমধ্যে কমপক্ষে ২৮ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। তিনি বলেন, অবৈধ ও বেআইনিভাবে গড়ে উঠা এসব বিদ্যুেকন্দ্রের অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই পরিত্যক্ত ও পুরনো। এগুলোর কোনোটাই শতভাগ চালানোর মতো নয়। ফলে যে বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে একশ’ মেগাওয়াট বিদ্যুত্ উত্পাদন হওয়ার কথা সেটা এখন ত্রিশ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।
রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের জ্বালানি ব্যয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্যাসভিত্তিক একটি বিদ্যুেকন্দ্রের মাধ্যমে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুত্ উত্পাদন খরচ পড়ে ১ টাকা সত্তর পয়সা থেকে দুই টাকার মতো। অথচ তেলভিত্তিক একটি কেন্দ্রের মাধ্যমে সেই বিদ্যুতের উত্পাদন খরচ পড়ে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। কাজেই জনগণের পকেট কেটে নিয়েও এ ভর্তুকি পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে এসব বিদ্যুেকন্দ্রের অবস্থা হচ্ছে, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া, বাতি যাবে নিভিয়া’র মতো অবস্থা। এসব কারণে সামনের দিনগুলোতে লোডশেডিং আরও তীব্র হবে বলে মনে করেন তিনি।
No comments:
Post a Comment