Saturday, September 8, 2012

গোলটেবিলে ড. আকবর আলি খান : প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়


গোলটেবিলে ড. আকবর আলি খান : প্রধানমন্ত্রীকে বহাল রেখে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়

প্রধানমন্ত্রী বা বর্তমান সংসদের অধীনে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি বলেন, বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে তিনি অন্য ১০ জন মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিতে পারেন। তাই এত ক্ষমতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকলে তার অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সুপ্রিমকোর্টের অবসরে যাওয়া বিচারপতিদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব দেন তিনি। গতকাল এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ (সিএসপিএস) ‘দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা : উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শাহ আবদুল হান্নান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প আরও একটি প্রস্তাব দিয়ে আকবর আলি খান বলেন, সুপ্রিমকোর্ট থেকে পাঁচ বা ১০ বছরের মধ্যে অবসরে যাওয়া বিচারপতিদের মধ্য থেকে একজনকে লটারির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্বাচন করা যেতে পারে। অথবা ১৫-২০ জনের একটি তালিকা থেকে উভয়পক্ষের সম্মতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্বাচন করা যেতে পারে। এছাড়া আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সর্বশেষ পাঁচ প্রধান বিচারপতিদের মধ্য থেকে যারা উপদেষ্টা হতে রাজি হবেন তারা নির্ধারণ করবেন কে প্রধান উপদেষ্টা হবেন। এটি করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে।
ড. আকবর আলি খান বলেন, নির্বাচন কমিশনকে যতই শক্তিশালী করা হোক, বর্তমান সংসদ বহাল থাকলে তাদের পক্ষে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আবার বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে সরকারি দল ইচ্ছা করলে ৯০ ভাগ আসন পাওয়া সত্ত্বেও ফলাফল বাতিল ঘোষণা করতে পারবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি দলের আরও চারজন এবং বিরোধী দলের থেকে পাঁচজন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হতে পারে। তবে সরকারি দলের কারা কারা এতে থাকবে তা ঠিক করবে বিরোধী দল। অনুরূপভাবে বিরোধী দলের কোনো পাঁচজন তা ঠিক করবে সরকারি দল।
এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমস্যা সম্পর্কে তিনি বলেন, নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের কাছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় দেয়া হলেও ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা অন্য মন্ত্রণালয়গুলো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং নির্বাচন কমিশন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না। আকবর আলি খান আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করা এবং বর্তমানে এটি তুলে দেয়ার সময়ও সংসদে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যবস্থার স্থায়ী কোনো সমাধান হতে পারে না। এ ব্যবস্থায় কত দিন চলবে তা সময় নির্ধারণ না করা ছিল সব চেয়ে বড় ভুল। তিনি বলেন, সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী যদি বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন আগে নির্বাচন দেয়া হয় ও ক্ষমতাসীনরা যদি ১০ শতাংশ আসন পায় এবং জালিয়াতির অভিযোগে ওই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা হয়, তখন কী হবে? বিদ্যমান সংবিধানে এ সুযোগটি রয়ে গেছে। এটি সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন দিলে সংসদ সদস্যরা অন্যদের চেয়ে কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে, যা নির্বাচনে সমান সুযোগ তৈরির পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কেউই আর গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে সংঘাত ছিল, আছে ও থাকবে। তবে গত ৪০ বছরে কোনো অন্যায়, অবিচার টেকেনি। আগামী ৪০ বছরেও পারবে না। বর্তমানে যে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দিয়েছে, এর রাজনৈতিক সমাধান করতে হলে আগে লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক উপায়ে করতে হবে। অরাজনৈতিক উপায়ে এটি সমাধানের চিন্তা করা ঠিক হবে না। অরাজনৈতিক কোনো কিছুই বাংলাদেশসহ পৃথিবীর কোথাও টেকসই হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। প্রবন্ধে তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা বলে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থেকে যে নির্বাচন করেন, সেই নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না। এ জন্য নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সঙ্কটাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিদ্যমান সঙ্কট নিরসনে নির্দলীয় সরকারের ছয়টি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। প্রস্তাবগুলো হলো : এক. বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে মহাজোট সরকার পদত্যাগ করবে এবং একটি নির্দলীয় সরকার শুধু তিন মাসের জন্য দায়িত্ব নেবে। দুই. একটি ‘এলডার্স কাউন্সিল’ নির্দলীয় সরকারের দায়িত্ব নেবে, যারা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করবে। তিন. একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির (অথবা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির) নেতৃত্বে সাংবিধানিক পদে অধিকারীদের নিয়ে একটি সরকার। চার. স্পিকারের নেতৃত্বে দুটি বড় দলের পাঁচজন করে নিয়ে একটি সরকার। তবে তারা কেউই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। পাঁচ. যৌথ নেতৃত্বে (একজন বিএনপি ও একজন আওয়ামী লীগের মনোনীত) একটি নির্দলীয় সরকার, যাদের কেউই আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। এবং সর্বশেষ হচ্ছে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি সরকার নির্বাচনের আয়োজন করবে।
গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় আরও অংশ নেন সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক সচিব এসএম জহরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সুকুমার বড়ুয়া, সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ফেরদৌস আক্তার ওয়াহিদা এমপি, দৈনিক নিউ নেশনের সম্পাদক মোস্তাফা কামাল মজুমদার, বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য ইসমাইল হোসেন বেঙ্গল প্রমুখ।
আবুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া ছাড়াও প্রতিনিয়তই দেশের অসংখ্য মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে। যাদের খবর আমরা জানি না। দেশে অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায় গেছে, সংবিধান ও আইনের প্রতি মানুষের আস্থা নেই। সুতরাং সব কিছুর আগে জনগণের ও বিরোধী দলের আস্থা ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশ সংঘাতের দিকে যাবে। আলোচনার মাধ্যমে তিনি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচনের দাবি জানান।
মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, বিদেশি সরকার, নাকি জনগণের সরকার নাকি ক্ষমতাসীন দলের সরকার দ্বারা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে জনগণ দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করে এ সঙ্কট সমাধান করা দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এছাড়া বৈঠকে বক্তারা বলেন, সরকার যদি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চায় তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই আবার ক্ষমতায় আসার জন্য প্রভাব খাটাবে। এমনকি তারা প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে সংঘাতের দিকেও দেশকে ঠেলে দিতে পারে। তা ছাড়া সংসদ সদস্য পদে থেকে এ পদের জন্য নির্বাচন করা সংবিধানের পরিপন্থী। বর্তমান সরকারের অধীনে নয়, বরং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া দরকার বলে বক্তারা মন্তব্য করেন।

No comments:

Post a Comment