৯ মাস ধরে সরকার থেকে পালানোর চেষ্টা করছি

শেয়ারবাজারে ধস, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি ও সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে সমালোচিত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, গত ৯ মাস ধরেই তিনি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করছেন সরকার থেকে বের হয়ে যাওয়ার। সেটা অবশ্য হলমার্ক কেলেঙ্কারির জন্য নয়, তিনি অব্যাহতি নিতে চেয়েছেন তার স্বাস্থ্যগত কারণে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে তার পদত্যাগের দাবি উঠলেও মুহিত জানিয়েছেন এ ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের আইনসিদ্ধ পদ্ধতিতে ‘পাবলিক ট্রায়াল’ (প্রকাশ্যে বিচার) হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মুহিত বলেন, ‘অনেক দিন থেকেই (আমার পদত্যাগের) দাবি-টাবি আসছে। আমি এগুলো দেখেছি। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।’ প্রথমবারের মতো পদত্যাগের অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করে এ সময় মুহিত আরও বলেন, ‘আমি নয় মাস ধরেই সরকার থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি সরকার থেকে বের হয়ে যাওয়ার (গেট আউট অব দ্য গভর্নমেন্ট)। তবে সেটা সমালোচনার কারণে নয়। সেটা স্বাস্থ্যগত কারণে। তবে ইচ্ছা করলেই সবকিছু হয় না।’ এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আর ফখরুল সাহেব আছেন, উনি শুরুও করবেন এটা (আমার পদত্যাগ চেয়ে) দিয়ে, আর শেষও করবেন এটা দিয়ে। তবে উনি প্রায়ই অনেক অসত্য কথা বলেন।’
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মুহিত বলেন, পদ্মা সেতু ও ড. ইউনূস অনেক পুরনো প্রসঙ্গ। নতুন ইস্যু হচ্ছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি। হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে আগের অবস্থান পাল্টে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হলমার্কের সঙ্গে বড় বড় লোক জড়িত। এরা দেশের ব্যাংকিং খাতে ধস নামিয়েছে। দেশের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে।’ হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে একটি বড় ধরনের দুর্নীতি বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কেবল সোনালী ব্যাংক নয়, হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত। জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে মামলা করা জরুরি। মামলা অনুযায়ী কিছু ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। এর সঙ্গে জড়িতরা দেশ ছেড়ে পালানোর ফন্দিফিকির করছে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মতোই আমিও আগুনের মুখে আছি। তবে আগুন দেখে পালিয়ে গেলে হয় না, নেভানোর চেষ্টা করতে হয়।’
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, হবেও না। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদত্যাগ জরুরি নয়, তিনি ছুটিতে গেলেই হয়। তবে আপাতত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না—এমন ইঙ্গিত দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণের বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী শিগগিরই ওয়াশিংটন যাবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করার পর থেকেই সরকার থেকে পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আসছেন অর্থমন্ত্রী। দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, এমন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের শীর্ষ মহল রাজি না হওয়ায় অর্থমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর মতবিরোধের বিষয়টিও অনেকটা স্পষ্ট। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে মসিউর রহমানের পদত্যাগের সম্ভাবনা ঘনিয়ে আসায় একটি বিবৃতি তৈরি করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে মসিউর পদত্যাগ না করায় বেশ কয়েকটি তারিখ পিছিয়েও এ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের বিশ্বকাঁপানো দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা না হতেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বৃহত্তম দুর্নীতি হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাও প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নিরীক্ষায় সোনালী ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলার তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই তুলে নেয় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি।
গণমাধ্যমে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর কাছে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ চিঠির তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে চিঠি দেয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। সোনালী ব্যাংক নিয়ে কথা যত কম হবে, ততই মঙ্গল। এ বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী হলমার্ক কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ নিয়েছেন—বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এর মধ্যেই জানা গেছে যে, হলমার্কের নজিরবিহীন কেলেঙ্কারিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজন জড়িত; জড়িত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও। তবে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মধ্যেই হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় থেকে পরিচালনা পর্ষদকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলামের মেয়াদকাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাবে পরিচালনা পর্ষদের এমন তিনজন সদস্যকেও পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে আসছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে সোনালী ব্যাংকের দুজন মহাব্যবস্থাপককে (জিএম) অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আর দুজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) ওএসডি করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, একজন প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার নাম উঠে আসে। অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, সরকারের প্রভাবশালীদের রক্ষার জন্যই সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। অন্যদিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে হলমার্কের কর্তাব্যক্তিরা। তবে গতকাল প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী হলমার্কের বিরুদ্ধে মামলা করার ইঙ্গিত দেন।
সম্প্রতি এক কর্মশালায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কোনো ঘটনা নয়। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর অভ্যন্তরীণ খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে অসুবিধা হয়েছে। ৪০ হাজার কোটি টাকার তুলনায় ৪ হাজার কোটি টাকা খুব বেশি নয় বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অর্থমন্ত্রীর কাছে আরও বড় অঙ্কের দুর্নীতির তথ্য রয়েছে বলেই তিনি চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকে ছোট ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বলে দাবি করেছেন বিরোধীদলীয় নেতারা।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় অর্থমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমেরও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে গণমাধ্যমে খুব বেশি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সংবাদ মাধ্যমের সংস্কারের দাবিও জানান তিনি।
এরপর বৃহস্পতিবার নিজ বক্তব্যের জন্য জাতীয় সংসদে দুঃখ প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার এ বক্তব্যের কারণে দুর্নীতি উত্সাহিত হতে পারে। আমি চাই না, দুর্নীতি উত্সাহিত হোক। সেজন্য আমি আমার এ বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি এবং বক্তব্যটি প্রত্যাহার করছি।’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে বোধহয় আমি দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। এজন্য আমি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করব না। ওইদিন ওইভাবে আমার কথাটা বলা ঠিক হয়নি। এর জন্য আমি সবার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি, সংসদ ও জাতির কাছে ক্ষমা চাইছি
গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মুহিত বলেন, ‘অনেক দিন থেকেই (আমার পদত্যাগের) দাবি-টাবি আসছে। আমি এগুলো দেখেছি। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি।’ প্রথমবারের মতো পদত্যাগের অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করে এ সময় মুহিত আরও বলেন, ‘আমি নয় মাস ধরেই সরকার থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি সরকার থেকে বের হয়ে যাওয়ার (গেট আউট অব দ্য গভর্নমেন্ট)। তবে সেটা সমালোচনার কারণে নয়। সেটা স্বাস্থ্যগত কারণে। তবে ইচ্ছা করলেই সবকিছু হয় না।’ এ সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আর ফখরুল সাহেব আছেন, উনি শুরুও করবেন এটা (আমার পদত্যাগ চেয়ে) দিয়ে, আর শেষও করবেন এটা দিয়ে। তবে উনি প্রায়ই অনেক অসত্য কথা বলেন।’
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মুহিত বলেন, পদ্মা সেতু ও ড. ইউনূস অনেক পুরনো প্রসঙ্গ। নতুন ইস্যু হচ্ছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি। হলমার্ক কেলেঙ্কারি সম্পর্কে আগের অবস্থান পাল্টে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘হলমার্কের সঙ্গে বড় বড় লোক জড়িত। এরা দেশের ব্যাংকিং খাতে ধস নামিয়েছে। দেশের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে।’ হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে একটি বড় ধরনের দুর্নীতি বলে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কেবল সোনালী ব্যাংক নয়, হলমার্কের অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত। জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে মামলা করা জরুরি। মামলা অনুযায়ী কিছু ব্যবস্থা গ্রহণও জরুরি। এর সঙ্গে জড়িতরা দেশ ছেড়ে পালানোর ফন্দিফিকির করছে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের মতোই আমিও আগুনের মুখে আছি। তবে আগুন দেখে পালিয়ে গেলে হয় না, নেভানোর চেষ্টা করতে হয়।’
পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি, হবেও না। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের পদত্যাগ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদত্যাগ জরুরি নয়, তিনি ছুটিতে গেলেই হয়। তবে আপাতত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না—এমন ইঙ্গিত দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণের বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী শিগগিরই ওয়াশিংটন যাবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করার পর থেকেই সরকার থেকে পদত্যাগের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আসছেন অর্থমন্ত্রী। দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, এমন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে সরকারের শীর্ষ মহল রাজি না হওয়ায় অর্থমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর মতবিরোধের বিষয়টিও অনেকটা স্পষ্ট। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতে মসিউর রহমানের পদত্যাগের সম্ভাবনা ঘনিয়ে আসায় একটি বিবৃতি তৈরি করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পরে মসিউর পদত্যাগ না করায় বেশ কয়েকটি তারিখ পিছিয়েও এ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের বিশ্বকাঁপানো দুর্নীতির অভিযোগের সুরাহা না হতেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বৃহত্তম দুর্নীতি হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকারি দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাও প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নিরীক্ষায় সোনালী ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলার তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই তুলে নেয় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকারও বেশি।
গণমাধ্যমে বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থমন্ত্রী এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শফিকুর রহমান পাটোয়ারীর কাছে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ চিঠির তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিয়ে চিঠি দেয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। সোনালী ব্যাংক নিয়ে কথা যত কম হবে, ততই মঙ্গল। এ বক্তব্যের পর অর্থমন্ত্রী হলমার্ক কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে সোনালী ব্যাংকের পক্ষ নিয়েছেন—বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এর মধ্যেই জানা গেছে যে, হলমার্কের নজিরবিহীন কেলেঙ্কারিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের লোকজন জড়িত; জড়িত সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদও। তবে দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার মধ্যেই হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় থেকে পরিচালনা পর্ষদকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি দিয়েছে সরকার। দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী বাহারুল ইসলামের মেয়াদকাল অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাবে পরিচালনা পর্ষদের এমন তিনজন সদস্যকেও পুনঃনিয়োগ দেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায় ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে আসছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে সোনালী ব্যাংকের দুজন মহাব্যবস্থাপককে (জিএম) অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আর দুজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) ওএসডি করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, একজন প্রতিমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার নাম উঠে আসে। অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, সরকারের প্রভাবশালীদের রক্ষার জন্যই সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। অন্যদিকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে হলমার্কের কর্তাব্যক্তিরা। তবে গতকাল প্রথমবারের মতো অর্থমন্ত্রী হলমার্কের বিরুদ্ধে মামলা করার ইঙ্গিত দেন।
সম্প্রতি এক কর্মশালায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কোনো ঘটনা নয়। তিনি আরও বলেন, চলতি বছর অভ্যন্তরীণ খাতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে অসুবিধা হয়েছে। ৪০ হাজার কোটি টাকার তুলনায় ৪ হাজার কোটি টাকা খুব বেশি নয় বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্য অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অর্থমন্ত্রীর কাছে আরও বড় অঙ্কের দুর্নীতির তথ্য রয়েছে বলেই তিনি চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতিকে ছোট ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বলে দাবি করেছেন বিরোধীদলীয় নেতারা।
বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় অর্থমন্ত্রী সংবাদ মাধ্যমেরও সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে গণমাধ্যমে খুব বেশি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সংবাদ মাধ্যমের সংস্কারের দাবিও জানান তিনি।
এরপর বৃহস্পতিবার নিজ বক্তব্যের জন্য জাতীয় সংসদে দুঃখ প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার এ বক্তব্যের কারণে দুর্নীতি উত্সাহিত হতে পারে। আমি চাই না, দুর্নীতি উত্সাহিত হোক। সেজন্য আমি আমার এ বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি এবং বক্তব্যটি প্রত্যাহার করছি।’ অর্থমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে বোধহয় আমি দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। এজন্য আমি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করব না। ওইদিন ওইভাবে আমার কথাটা বলা ঠিক হয়নি। এর জন্য আমি সবার কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি, সংসদ ও জাতির কাছে ক্ষমা চাইছি
No comments:
Post a Comment