Thursday, September 6, 2012

জাতীয় ঐক্য ও আলেম সমাজ


জাতীয় ঐক্য ও আলেম সমাজ

আমাদের জাতীয় পরিচয় বা জাতীয়তা বলতে আমরা বাংলাদেশী। অর্থাৎ বাংলাদেশে বসবাসকারী মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, চাকমা, গারো, নাগা আরো যত আছে সবাই আমরা বাংলাদেশী। এটাই আমাদের জাতীয় পরিচয়। আমাদের দেশ বাঁচলে জাতীয় পরিচয় বাঁচবে আর আমাদের জাতীয় পরিচয় থাকলেই জাতীয় পতাকা থাকবে। জাতীয় পরিচয় ও জাতীয় পতাকা বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন সবার আগে দেশ বাঁচানো। দেশ বাঁচাতে ও জাতীয় পরিচয় রায় জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী যেহেতু মুসলমান আর এ বিরাট মুসলিম জনগোষ্ঠী এ দেশের আলেম ওলামাদের বিশ্বাস করে, ভক্তি করে, শ্রদ্ধা করে, মানে ও অনুসরণ করে। তাই মুসলিম মিল্লাত ও এই মিল্লাতের আলেমদের দায়িত্ব অনেক বেশি। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী এই জনগোষ্ঠীর আলেমদের দিকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীও তাকিয়ে আছে।
জাতি বলতে বুঝি বিশেষ করে কুরআনের ভাষায় ‘মিল্লাতা আবিকুম ইবরাহিম, হুয়া ছাম্মাকুমুল মুছলিমিন, মিন ক্কাবলু ওয়াফি-হাজা’ অর্থÑ তোমরা তোমাদের (জাতির) পিতা ইব্রাহিমের ‘দ্বীন’-এর ওপর কায়েম থেকো, তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন,‘মুসলিম’ আর এ কুরআনেও এ নামই (মুসলিম) দেয়া হয়েছে’ (সূরা হজ-৭৮)। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যখন আমি তাকে (ইব্রাহিম আ:কে) নির্দেশ দিলাম, তুমি মুসলিম হয়ে যাও, সে (ইব্রাহিম আ:) বলল আমি সৃষ্টিকুলের মালিকের আনুগত্য স্বীকার করছি (বা মুসলিম হয়েছি)’(সূরা বাকারা-১৩১)। 
আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ করছেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেমনি তাঁর জন্য জিহাদ করা প্রয়োজন’ (সূরা হজ-৭৮)। জিহাদ কেন করতে হবে সে ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসূল সা:কে সুস্পষ্ট পথনির্দেশ ও সঠিক জীবনবিধান (দ্বীন) দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে করে (দুনিয়ায় প্রচলিত) সব জীবনবিধানের (দ্বীনের) ওপর আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী করে দিতে পারেন’ (সূরা সফ-৯)। যারা ঈমানের দাবিদার তাদের আল্লাহ তায়ালা নেতৃত্বের জন্যও মনোনীত করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘তিনি দুনিয়ায় নেতৃত্বের জন্য তোমাদেরকেই মনোনীত করেছেন’ (সূরা হজ-৭৮)। আল্লাহ তায়ালা জিহাদ করতে বলেছেন আমাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য, তাও একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা (দ্বীন) দেয়ার পর। সূরা আল মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের ওপর আমার প্রতিশ্র“ত নেয়ামত ওপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্য জীবনবিধান হিসেবে আমি ইসলামকে মনোনীত করলাম।’ আল্লাহ তায়ালা আরো ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আমার প থেকে মনোনীত একমাত্র জীবনব্যবস্থা (দ্বীন) হচ্ছে ইসলাম’ (সূরা আল ইমরান-১৯)। অতএব আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সঙ্কীর্ণতা রাখেননি’ (সূরা হজ-৭৮)। 
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। এ দেশে আজ যা হচ্ছে তা মেনে নেয়া যায় না। কোনো ঈমানদার তা মেনে নিতে পারেন না। আজকের সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থা মনে করিয়ে দেয় কুরআনের সে আয়াত যেখানে আল্লাহ তায়ালা তাগিদ দিয়ে বলছেন, ‘আর তোমাদের কী হলো, তোমরা কেন আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছ না ওই সব নির্যাতিত, অসহায় শিশু, নারী-পুরুষের জন্য যারা নির্যাতনে কাতর হয়ে ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের ‘রব’ আমাদের এ জালেম অধ্যুষিত জনপদ থেকে উদ্ধার করে অন্যত্র সরিয়ে নাও, অতঃপর তুমি আমাদের জন্য তোমার মনোনীত একজন অভিভাবক পাঠাও, আর তোমার কাছ থেকে একজন সাহায্যকারী দাও (আন নিসা-৭৫)। 
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। বিশেষ করে কালেমায় বিশ্বাসী সব মুসলিম দাবিদারকে প্রশ্ন হচ্ছে কে এ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে? আল্লাহ তায়ালার হুকুম হচ্ছে, ‘তোমরা সংঘবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো, আর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আল ইমরান-১০৩)। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ওই সব লোককে ভালোবাসেন, যারা সুসংগঠিতভাবে আল্লাহর জমিনে তাঁর ‘দ্বীন’ প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে, যেন তারা এক সিসাঢালা সুদৃঢ় প্রাচীর’ (সরা আস সফ-৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমরাই আল্লাহকে বেশি ভয় করে চলে’ (সূরা আল ফাতির-২৮) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘যে জানে আর যে জানে না উভয়ই কি সমান হতে পারে ? নিশ্চয়ই জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোকেরাই আল্লাহকে বেশি মানে’ (সূরা আজ জুমার-৯)। আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহর হুকুম মানো, রাসূল সা:-এর আনুগত্য করো, আনুগত্য করো তোমাদের মাধ্যে ওলিল আমরের’ (আন নিসা-৫৯)। 
আল্লাহ তায়ালার এসব ঘোষণা ও নির্দেশনা অনুযায়ী ‘ওলিল আমর’ বলতে আলেমদেরই বোঝায়। কারণ (১) আল্লাহর কাছে আলেমদের মর্যাদা অনেক বেশি (২) রাসূল সা: আলেমদের তাঁর ওয়ারিশ বলেছেন। রাসূল সা: আরো বলেছেন, আমি আমার ওয়ারিশদের জন্য কোনো বিষয়-সম্পত্তি রেখে যাইনি, আমি রেখে যাচ্ছি আল্লাহর কালাম ও আমার সুন্নাহ। তাই আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে, রাসূল সা: যে কাজ যেভাবে করেছেন, সে কাজ সেভাবে করা। রাসূল সা: মানুষকে আল্লাহর আয়াত শুনাতেন, জীবন পরিশুদ্ধ ও উৎকর্ষিত করতেন, কিতাব ও হিকমত শিা দিতেন, মানুষ যে বিষয়ে জানত না তা জানাতেন’ (বাকারা-১৫১)। কিন্তু কোনো বিনিময় গ্রহণ করতেন না’ (সূরা ইয়াছিন-২১)। রাসূল সা:-এর ওয়ারিশ হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করা সব আলেমের ওপর ওয়াজিব।
আলেম সমাজ যদি ওয়াজ বা মিলাদ মাহফিলে, জুমার খুতবায়, প্রত্যেক ওয়াক্ত সালাতের আগে বা পরে লোকদের কুরআন ও সহীহ হাদিস থেকে হালাল-হারাম, হক-বাতিল, সুদ-ঘুষ, জিনা-ব্যভিচার, তাগুত ও কুফর সম্পর্কে জ্ঞানদান করেন তা হলে মুসলিম মিল্লাত অবশ্যই জ্ঞানের আলোতে আলোকিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হবে। সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারত যে, সালাতে সে আল্লাহর সামনে কী বলে আর বাস্তবে কী করে ! তাহলেও হয়তো বা সমাজের এত অবয় হতো না। এগুলো মানুষকে জানানোর দায়িত্ব হচ্ছে ইমামসহ সব আলেম সমাজের। 
বর্তমানে দেশের শান্তিকামী ও ইসলামপ্রিয় জনগণসহ আলেম-ওলামাদের ওপর চলছে নির্যাতন আর নিপীড়ন। এহেন অবস্থায় একজন আলেম যাকে আল্লাহ তায়ালা হক-বাতিল বোঝার জ্ঞান দিয়েছেন ও রাসূল সা:-এর ওয়ারিশের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি কিভাবে স্বস্তিতে ঘুমোতে পারেন! কী জবাব দেবেন সে ‘রব’-এর কাছে যিনি আপনাকে কুরআন ও হাদিসের জ্ঞানদান করে সম্মানিত করেছেন। যার কারণে আপনি নামের আগে, ক্বারী, হাফেজ, মুফতি, মুফাসসির, মাওলানা, আল্লামা, শায়খুল হাদিস, মুহতামিম, মুহাদ্দিস, ইমাম বা খতিব এসব বিশেষণ ব্যবহার করে নিজেকে ধন্য মনে করেন! যে কারণে আপনাকে মানুষ অনেক েেত্র পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজনের চেয়ে অধিক সম্মান করে দাওয়াত দিয়ে উত্তম খাদ্য খাওয়ানোর পর আপনার হাতে কিছু হাদিয়া বা তোহফা তুলে দেয়! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: আলেমদের সম্মানিত করার কারণে সাধারণ মানুষও সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে, আপনাদের কথা বিশ্বাস করে, মানে ও অনুসরণ করে। একটু চিন্তা করুনÑ আল্লাহ তায়ালা, তাঁর রাসূল সা:সহ সহজ-সরল বিশ্বাসী এসব মানুষকে হাশরের দিন কী জবাব দেবেন? সম্মানিত আলেমরা এখনো সময় আছে, লোকদের কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞানের আলোকে আলোকিত করে জাগিয়ে তুলুন ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর ‘দ্বীন’ কায়েমের চেষ্টা করুন। এটা হতে পারে নাজাতের অছিলা। আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য জিহাদ করো, যেমনি জিহাদ করা প্রয়োজন’ (সূরা হজ-৭৮)। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা, ‘অতএব, আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা উচিত ওই সব লোককে যারা পার্থিব সুখ-শান্তি আখেরাতের বিনিময়ে বিক্রি করে দিতে পারে, যারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে ও নিহত হয় কিংবা বিজয়ী, তাদের (দুনিয়া ও আখিরাতে) বিরাট সফলতা দান করব’(সূরা নিসা-৭৪)। 
সম্মানিত আলেমদের স্মরণ করা প্রয়োজন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘(স্মরণ করো!) আমি এ কিতাবধারী লোকদের (যাদের কিতাবের জ্ঞান দেয়া হয়েছে তাদের) কাছ থেকে প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করেছিলাম, আমি বলেছিলাম, তোমরা একে (কিতাবকে) মানুষের কাছে বর্ণনা করবে এবং একে (কিতাবকে) তোমরা গোপন করবে না, কিন্তু তারা এ ওয়াদা নিজেদের পেছনে ফেলে রাখল এবং অতি অল্প মূল্যে তা বিক্রি করে দিলো, বড়ই নিকৃষ্ট ছিল তাদের এ বেচাকেনার কাজটি! (আল ইমরান-১৮৭)। আল্লাহ তায়ালাএ প্রশ্নও করেছিলেন, আলআছতু বি-‘রাব্বি’কুম? আমরা বলেছিলাম, ‘ক্কালু বালা’ (আ’রাফ-১৭২)। সম্মানিত আলেমরা আল্লাহর সাথে প্রতিশ্র“তিমাফিক আমরা কি অর্জিত জ্ঞান মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি ? নাকি অর্জিত জ্ঞান বিতরণের পরিবর্তে বিক্রি করছি ? যদি জ্ঞান বিতরণের পরিবর্তে বিক্রি করি বা গোপন করি তার পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করছেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আমার অবতীর্ণ কিতাবের আয়াত গোপন করে, সামান্য মূল্যে তা বিক্রি করে, বিনিময়ে যা হাছিল করে নিজেদের পেট পূর্ণ করে, তা মূলত জাহান্নামের আগুন ছাড়া আর কিছুই নয়, শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের সেদিন পবিত্র বলেও ঘোষণা করবেন না, আর তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ আজাব’ (বাকারা-১৭৪)। 
সাধারণত আমাদের দেশের আলেমদের মধ্যে একজন আর একজনকে মেনে নিতে পারেন না বা সম্মান করেন না। আমাদের দেশে আজ সব বাতিল শক্তি এক মঞ্চে। একজনের নেতৃত্বে ইসলাম ধ্বংসের চেষ্টা করছে। দুর্ভাগ্য আমরা মুসলিম! আলেম! আমরা কাউকে মেনে নিয়ে এক মঞ্চে আসতে পারছি না। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক হলেও বাতিলের তথা শয়তানের বিজয় হিসেবেই দেখতে হবে। আলেমরা কেউ কিন্তু দাবি করতে পারবেন না যে আমিই সঠিক পথে আছি। ভুল-ত্র“টি থাকা মানুষ হিসেবে এটা স্বাভাবিক। আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা করা। এটা না করে আমরা একজন আর একজনকে কাফের বা তার চেয়েও খারাপ মনে করে ঘৃণা করি। আমরা একজন আর একজনকে সালাম পর্যন্ত দিতে চাই না। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মোমেন আর এক মোমেনের ভাই, অতএব ভাইদের মাঝে বিরোধ দেখা দিলে তা মীমাংসা করে দাও, আর আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের ওপর দয়া করা হবে’। এ বিশ্বাস নিয়েই আমাদের আলেম সমাজ কাজ করলে এ দেশ ও জাতি রা পাবে। দেশ ও জাতির আলেমরা যদি তাদের জ্ঞান আর ঈমানের দাবির হক আদায় করে দায়িত্ব পালন করতে পারেন তা হলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই কল্যাণদানের ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা করেছেন।

No comments:

Post a Comment