রামুর ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি চান খালেদা
![]() |
বুধবার রাতে গুলশানে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে রামু উখিয়া হোয়াইক্যং ও পটিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সম্প্রদায়ের লোকজন সাক্ষাত করতে এলে তিনি তাদের ক্ষতির বিবরণ শুনে এ কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, “সরকার যদি শাস্তির ব্যবস্থা না করে তবে আমরা করবো। অপরাধীদের একদিন না একদিন বের করে শাস্তি দেওয়া হবে।”
বিএনপি প্রধান বলেন, “আপনারা মনে অনেক কষ্ট নিয়ে আমাদের কাছে এসেছেন। ২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনায় আমরা সবাই অত্যান্ত দুঃখিত ও মর্মাহত। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে এই ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না।”
তিনি বলেন, “এই ঘটনা ঘটার পর আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের দলের নেতা মওদুদ আহমদ এর নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দিয়েছি। তারা সব তথ্য নিয়ে এসেছে। কালকে আমার কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। পরবর্তীতে তারা সংবাদ সম্মেলন করবে।”
খালেদা জিয়া বলেন, “কারো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আঘাত করা নিঃসন্দেহে যে ধর্মেরই হোক তার নিন্দনীয়। এতে মানসিক আঘাত লাগবেই। আমরা সব ধর্মকে সম্মান করি। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় ছুটি থাকে। তাদের সঙ্গে আমরা মতবিনিময় করি। হিন্দুসহ সব সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলি।”
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যাওয়ার দাবির জবাবে তিনি বলেন, “আমি অবশ্যই যাব। সবার সঙ্গে কথা বলবো। আর আজকে আপনারা যেসব দাবি দিয়েছেন তা পূরণ করার চেষ্টা করবো। আপনারা জানেন, আমরা বিরোধীদলে আছি। তারপরও বিরোধীদল হিসেবে আমরা দায়িত্ব পালন করি। বন্যা হলে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ছুটে যাই। কক্সবাজারেও তাৎক্ষণিকভাবে লোক পাঠিয়েছি। আরো চেষ্টা করবো। যতটুকু সাহায্য করার তা করবো।”
তিনি বলেন, “কিন্তু প্রধান দায়িত্ব হলো সরকারের। তাদের দায়িত্ব হলো সব প্রতিষ্ঠান আবার নতুন করে গড়ে দেওয়া। যাতে আপনারা পুনরায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারেন।”
সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, “আমি দাবি জানাবো ওই এলাকায় যেন সার্বক্ষণিকভাবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন এরকম অঘটন ঘটাতে সাহস না করে। আর যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের দলমত নির্বিশেষে ধরে শাস্তি দিতে হবে।”
পুলিশ কেন ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করলো না এই প্রশ্ন তুলে খালেদা জিয়া বলেন, “যারা দায়িত্ব ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেনি, তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”
তিনি বলেন, “বিএনপি সব সময় আপনাদের পাশে আছে ও থাকবে।
আমি চীন থেকে এসেই ওখানে যাব।”
তিনি অভিযোগ করেন, “এ সরকার তদন্ত না করেই কোনো ঘটনা ঘটলে কথায় কথায় বিরোধীদলেরওপর দোষ চাপায়। অপরাধ কারা করেছে তা না জেনে কারো নাম এভাবে বলা উচিত না।”
তিনি বলেন, “উচ্চ পর্যায়ের একটি নিরপেক্ষ টিম গঠন করে যারা দোষী তাদের শাস্তি দিলে কিছুটা হলেও যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা মনে শান্ত্বনা পাবে।”
অনুষ্ঠানে রামুর রামকোট বৌদ্ধ তীর্থের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো, খরুলিয়ার বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত জ্যোতি বোধি ভিক্ষু, রামুর বৌদ্ধ বিহারের বিশুদ্ধাবংশ ভিক্ষু, উখিয়ার বৌদ্ধ বিহারের কোলিয় বংশ ভিক্ষু, উখিয়ার ভালুকিয়া বৌদ্ধ বিহারের সভাপতি দীপক বড়ুয়া, উত্তর বড়বিল বৌদ্ধ বিহারের সভাপতি বাবু সেন বড়ুয়া, মরিয়া দীপংকর বৌদ্ধ বিহারের সভাপতি বাবু লাল বড়ুয়া, রেজুরকুল বৌদ্ধ বিহারের সভাপতি প্রেমানন্দ বড়ুয়া, খরুলিয়া ধর্মজ্যেতি বৌদ্ধ বিহারের সাধারণ সম্পাদক চন্দন বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের রামুর ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসী প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, প্রদীপ বড়ুয়া, বিকিরণ বড়ুয়া, মিঠুন বড়ুয়া, কক্সবাজার সদরের কিশোর বড়ুয়া, কানন বড়ুয়া, পরিমল বড়ুয়া, বাবু বড়ুয়া, সুরঞ্জন বড়ুয়া, সুধাংশু বড়ুয়া, খরুলিয়ার আকিঞ্চন বড়ুয়া, লোকনাথ বড়ুয়া, অনঙা বড়ুয়া, কানুনগো বড়ুয়া, টিসেন বড়ুয়া,সুনীল বড়ুয়া, পটিয়ার সুজন বড়ুয়া, বিকাশ বড়ুয়া, প্রদীপ বড়ুয়া, ধনু বড়ুয়া, অমলেন্দু বড়ুয়া, মিন্টু সরদার, রূপক শীল ও বিপ্লব চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য ফ্রন্টের আহ্বায়ক গৌতম চক্রবর্তী, বিএনপির সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক নিতাই রায় চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে রামুর রামকোট বৌদ্ধ তীর্থের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাবন্দা মহাথেরো
বলেন, “এ ঘটনায় বৌদ্ধদের মাঝে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আরাকানে নানা ঘটনা ঘটছে। সেজন্য বৌদ্ধরা আতঙ্কিত।”
তিনি বলেন, “একটা ভিত্তিহীন ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজার বছরের সম্প্রীতি নষ্ট করা হয়েছে। এর একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার।”
খালেদা জিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনি সেখানে যাবেন। তাহলে ক্ষতিগ্রস্তরা সাহস পাবে।”
পটিয়ার কোলাগাঁও সার্বজনীন রত্নপুর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ দীপানন্দ ভিক্ষু বলেন, “আমরা যার পূজা করি তার মূর্তি কিভাবে ভাঙা হয়েছে আপনি দেখে আসবেন। আমার বিহারে অনেক সম্পদ ছিল তা লুট করে নিয়ে গেছে। যে বা যারা করেছে আমি তাদের শাস্তি কামনা করি। আপনি যদি পটিয়ায় গিয়ে দেখে আসেন তাহলে ভাল হবে। শুধু কোলাগাঁও গ্রাম নয়, গোটা বৌদ্ধ সম্প্রদায় এখন আতঙ্কিত।
একজন ইউপি চেয়ারম্যান দীপক বড়ুয়া বলেন, “আমরা নির্বাক, আমরা হতবাক। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর ৪০ বছরে এরকম নির্মম নির্যাতন আর হয়নি। স্বাধীনতা সংগ্রামেও হয়নি।”
খালেদা জিয়াকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “ঘটনার পরপরই কমিটি করে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন, এজন্য আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি। ২৯ সেপ্টেম্বর যে ঘটনা ঘটেছে আমরা আশা করবো তার সত্য প্র্রকাশ পাবে।”
তিনি বলেন, “সেদিন প্রথম শোডাউন করেছে রাত ৯টা থেকে। রাত সাড়ে এগারোটা থেকে দুই ঘণ্টা মিছিল সভা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন জানে না।”
দীপক বড়ুয়া বলেন, “যদি প্রশাসন যথাযথভাবে উদ্যোগ ও ব্যবস্থা নিত তাহলে কোনো কিছু ঘটতো না। যারা সর্ব প্রথম মিছিল করেছে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে। তাদের ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া হলেও ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে আমরা অত্যন্ত ব্যাথিত।”
তিনি বলেন, “চেয়ারপারসন, আমরা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে এসেছি। আমরা অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত। যে কোনো মুহূর্তে আবার ঘটনা ঘটতে পারে।”
দীপক বড়ুয়া বলেন, “যেখান থেকে আমি চেয়ারম্যান হয়েছি, সেখানে কাস্টিং ভোটের ৯০ ভাগ মুসলিম ভোট।হাজার বছরের বৌদ্ধ বিহার যা পুড়ে গেছে তা শুধু বৌদ্ধদের সম্পদ নয়। এটা বাংলাদেশের সম্পদ। এই সম্পদ যে নষ্ট হয়ে গেল তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তিনি বলেন, “২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ঘটনা ঘটলো। ৩০ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে থাকাকালে পাশে উখিয়ায় আক্রমণ হলো। সাতটি বৌদ্ধ মন্দির ভেঙে ও পুড়িয়ে দেওয়া হলো। এটা কিভাবে সম্ভব হলো?”
দীপক বড়ুয়া বলেন, “চেয়ারপারসন, আপনি যদি সরেজমিনে গিয়ে দেখে আসেন তাহলে যারা ভয়ভীতিতে আছে তারা একটু সাহস পাবেন।”
পটিয়ার লাখেরা কোলাগাঁও ইউনিয়নের মানুষের পক্ষ থেকে তিনি চেয়ারপারসনের প্রতি চারটি দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো-
এক. একদিনের কর্মসূচি নিয়ে একটু কষ্ট করে দেখে আসবেন। নর-নারীদের শান্ত্বনা দিয়ে আসবেন।
দুই. আপনার পক্ষ থেকে একটি ত্রাণ কমিটি গঠন করে ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
তিন. ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির ও পরিবারের লোকদের হামলা মামলা থেকে রক্ষা করার জন্য সহযোগিতা করবেন।
চার. বর্তমানে এবং আগামীতে অসহায় এ জনগোষ্ঠীর দুর্বিষহ চিত্র তুলে ধরতে একজন প্রতিনিধি থাকলে ভাল হয়। এবং দেশি বিদেশি মহলে এই বিষয়টি তুলে ধরার জন্য আপনার কাছে অনুরোধ করছি।
উল্লেখ্য, ফেসবুকের প্রোফাইলে কোরআন এর অবমাননাকর ছবি থাকার অভিযোগ তুলে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ মন্দির ও ঘরবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর চালায় ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা।
রাতভর হামলায় সাতটি বৌদ্ধ মন্দির, অন্তত ৩০টি বাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয় আরো শতাধিক বাড়ি ও দোকানে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ওই ঘটনা তদন্তে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন। কমিটি গত শুক্র ও শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত করেছে।
No comments:
Post a Comment