Thursday, October 11, 2012

ডেসটিনি চেয়ারম্যান জে. হারুনসহ তিন কর্মকর্তা জেলহাজতে : আদালত প্রাঙ্গণে ডেসটিনি কর্মীদের পুলিশের লাঠিচার্জ


সাবেক সেনাপ্রধান ও ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদসহ ডেসটিনির তিন শীর্ষ কর্মকর্তা আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। মানি লন্ডারিং আইনসহ অর্থ আত্মসাত্ ও প্রতারণার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের দায়ের করা মামলায় গতকাল তাদের জামিন নামঞ্জুর করা হয়েছে। আসামিদের আদালত থেকে জেলহাজতে নেয়ার সময় কয়েকজন ব্যক্তি রাস্তায় শুয়ে ও মায়াকান্না জুড়ে প্রতিবাদ জানানোর চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের বেধড়ক পিটুনি দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এদিকে ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক সেনাপ্রধান ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পদত্যাগকারী সাধারণ সম্পাদক লে. জেনারেল (অব.) হারুনের জামিন আবেদন জানানো হয়েছে হাইকোর্টে। আদালত আগামী রোববার জামিন আবেদনের শুনানির দিন ধার্য করেছে।
জানা গেছে, গত ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদসহ ডেসটিনির ২২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলায় জামিন বাতিল হওয়ার পর দুদক তাদের গ্রেফতারের জন্য বিশেষ অভিযানে নামে। গ্রেফতার এড়াতে গতকাল লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদ, ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন ও ডেসটিনি ২০০০-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করেন। বৃহস্পতিবার ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ মো. জহুরুল হক শুনানি শেষে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ডেসটিনির তিন শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল সকাল ১০টার দিকে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত ওই আবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে আসামিপক্ষের আইনজীবী কাজী নজিবুল্লাহ হিরু এবং এহসানুল হক সমাজী তাদের জামিন আবেদনে বলেন, লে. জেনারেল হারুন সাবেক সেনাপ্রধান। ডেসটিনি ২০০০-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেন ও ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীন সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ডেসটিনির মাল্টিপারপাস ও ট্রি প্লান্টেশন কোম্পানি সমবায় আইনের কোনো ধরনের লঙ্ঘন করেনি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা আত্মসমর্পন করেছেন, তাদের জামিন দেয়া হোক। তাছাড়া গত ৬ আগস্ট আসামিরা নিম্ন আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন। জামিন পাওয়ার পর জামিনের কোনো শর্ত তারা লঙ্ঘন করেননি।
সিনিয়র আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী বলেন, আদালত যদি তাদের জামিন নামঞ্জুর করেন তবে সবার কাছে প্রমাণ হবে তারা দোষী। কিন্তু উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আছে, সব সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে চূড়ান্তভাবে রায় হওয়ার আগে কাউকে দোষী বলা যাবে না।
কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, ডেসটিনির ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকায় ৫৬ লাখ পরিবার না খেয়ে আছে। ডেসটিনির কোনো গ্রাহক কি দুদককে বলেছে যে তারা প্রতারিত হয়েছে! তবে কেন এবং কার ইশারায় লাখ লাখ লোককে না খাইয়ে রাখা হয়েছে? নজিবুল্লাহ হিরু আরও বলেন, এসব ষড়যন্ত্র। অবশ্যই এসবের নেপথ্যে কেউ একজন খেলছে। তারা কিসের স্বার্থে, কাদের স্বার্থে ডেসটিনিকে হয়রানি করছে? সেটি খতিয়ে দেখতে আদালতের প্রতি আবেদন জানান তিনি।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে দুদকের প্রধান আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে সরাসারি অভিযোগ করতে হয় না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে আমলযোগ্য অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা। ডেসটিনির হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছে। নিজেদের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিয়েছে। কোম্পানির সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৫৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে মাত্র ১৩ কোটি টাকা।
মামলার তদন্তের স্বার্থে তাদের জামিন আবেদন নাকচ করে আসামিদের কারাগারে পাঠানোর আহ্বান জানিয়ে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অভিনব কায়দায় জনগণকে প্রতারিত করে ডেসটিনির এসব কর্মকর্তা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও আত্মসাত্ করেছেন। বাদী-বিবাদী পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর আদালত আসামিদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ডেসটিনির বিরুদ্ধে মুদ্রা পাচারের দুটি মামলায় ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান লে. জেনারেল হারুনসহ ২২ আসামির জামিন বাতিল করে আদালত। এরপর থেকে তারা পলাতক ছিল।
গত ৬ আগস্ট মহানগর হাকিমের আদালতে আত্মসমর্পণ করে ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ ৬ জন জামিন নিয়েছিলেন। ওই আদেশের বিরুদ্ধে গত ১৩ আগস্ট দুদকের পক্ষ থেকে ডেসটিনির শীর্ষ পাঁচ কর্মকর্তার জামিনের আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য (রিভিশন) ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে আবেদন করা হয়। গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ড. আখতারুজ্জামান রিভিউ আবেদন গ্রহণ করেন এবং নিম্ন আদালতের আদেশ বাতিল করেন।
গত ১৩ আগস্ট আসামিপক্ষ ভারপ্রাপ্ত বিচারকের দেয়া আদেশের বিরুদ্ধে সিনিয়র বিশেষ জজ জহুরুল হকের কাছে আদেশ পুনর্বিবেচনার আবেদন জানান। আদালত ওই আবেদন গ্রহণ করায় ভারপ্রাপ্ত বিচারকের আদেশ বাতিল হয়ে যায়। এরপর বিচারক শুনানির জন্য ২০ সেপ্টেম্বর ধার্য করেন। ওইদিন রাষ্ট্র অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করেন। ওই শুনানিতে তিনি বলেছিলেন, জনগণের অর্থ আত্মসাতকারী চোরদের আবার সামাজিক মর্যাদা কিসের? রাষ্ট্রের স্বার্থে জনগণের অর্থ আত্মসাতকারীদের উপযুক্ত বিচারে সহায়তা করতে আমি এই আদালতে এসেছি।
ডেসটিনির ২২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে বিদেশে পাচারের অভিযোগে গত ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় দুটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। কমিশনের উপ-পরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মো. তৌফিকুল ইসলাম মুদ্রা পাচার প্রতিরোধ আইনে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেশন (এমএলএম) ও ট্রি প্লানটেশন প্রকল্পের নামে গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণ পেয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন।
ডেসটিনি কর্মীদের মায়াকান্না থামাতে বেধড়ক পিটুনি : তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় ডেসটিনির কয়েকশ’ কর্মী ব্যারিকেড দেয়ার চেষ্টা করে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী অ্যাডভোকেট বেলাল হোসেন জসিম বলেন, প্রথম দিকে পুলিশ ডেসটিনির ওই গ্রাহকদের কিছু বলেনি, বাধা দেয়নি। আসামিদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ২০-৫০ কর্মী গাড়ির সামনে শুয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। তারা আসামিদের ছেড়ে দিতে পুলিশের প্রতি অনুরোধ করে। এ সময় তারা পুলিশের পা জড়িয়ে ধরে। এরকম নাটকীয় অবস্থায় পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে ডেসটিনির কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে আসামিদের জেলহাজতে নেয়া হয়।
এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অপর আইনজীবী বলেন, দেখে মনে হয়েছে তারা আগে থেকেই পরিকল্পনা করে এসেছিল। তারা যখন হাউমাউ করে কাঁদছিল, তখন অন্য আইনজীবী ও উপস্থিত কিছু লোকজন চোর চোর বলে চিত্কার করে বলেন, চোরের শাস্তি হওয়া উচিত।
হাইকোর্টে জামিন আবেদন : বিশেষ জজ আদালতে জামিন আবেদন বাতিল হওয়ার পর গতকালই লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশীদের জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে। আগামী রোববার এ আবেদনের ওপর শুনানি হবে।
বৃহস্পতিবার বিকালে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি ফরিদ আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু। বিকালে তিনি হারুন-অর-রশীদকে চিকিত্সার জন্য বিএসএমএমইউ হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন করেন। তিনি আদালতে বলেন, লে. জে. (অব.) হারুন-অর-রশীদ সাবেক সেনাপ্রধান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার। তিনি গুরুতর অসুস্থ। হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। তাকে জামিন দেয়া বা না দেয়ার এখতিয়ার আদালতের আছে। তবে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর আবেদন করছি। তাকে হাসপাতালে পাঠানোর আবেদনের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তিনি (হারুন-অর-রশীদ) এখনও কারাগারে যাননি। কারাগারে গেলে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইজি প্রিজনকে বলব। তিনি বলেন, ‘হারুন-অর-রশীদের অসুস্থতার সমর্থনে কোনো কাগজপত্র নেই। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিন আবেদনের শুনানিতে অসুস্থতা সম্পর্কে কোনো কিছু বলা হয়নি।’
এ সময় আদালত বলে, ডেসটিনির অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক সেনাপ্রধান ও একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি সম্মানিত ব্যক্তি। এর আগেও তো হাসপাতালে পাঠানোর ঘটনা আছে। তাছাড়া আবদুল মতিন খসরুর কথা কি বিশ্বাসযোগ্য নয়? তাছাড়া তার কিছু হলে আপনি বা আমরা দায়ী হবো।
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী যা করার সব হবে। কারা কর্তৃপক্ষই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। হারুন-অর-রশীদ ডেসটিনি থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা বেতন নেন। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম থেকে পদত্যাগ করেছেন। তিনি ডেসটিনি ছাড়তে পারবেন না। তাই বলে কি উনি চোরদের সঙ্গে থাকবেন?’
জবাবে মতিন খসরু বলেন, ‘ডেসটিনির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি একজন কর্মচারী। চাকরিজীবী। পরিচালনা পরিষদই ডেসটিনি পরিচালনা করে থাকে। হারুন-অর-রশীদ ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান। এই চেয়ারম্যান পদ আলঙ্কারিক।
এরপর আদালত জামিন আবেদনের ওপর রোববার শুনানির দিন ধার্য করেন। তবে হারুন-অর-রশীদকে হাসপাতালে পাঠানোর বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে আদালত বলেন, আপনি আদালতকে আশ্বস্ত করেছেন, ন্যূনতম অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে পাঠাবেন।

No comments:

Post a Comment