Monday, September 10, 2012

ব্যাংকপাড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি


ব্যাংকপাড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি
দেশের ব্যাংকিং খাতে হরিলুট চলছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কর্তাদের সহায়তায় শক্তিশালী চক্র নানা কায়দায় ব্যাংকের টাকা লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। আর এ সব লুটপাটে সহায়তা করছে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংককে। এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উধাও হয়ে গেছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্কসহ ছয়টি প্রতিষ্ঠানের চার হাজার কোটি টাকার সন্ধান মিললেও অবশিষ্ট ছয় হাজার কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। জানা গেছে, এই বিপুল অংকের টাকা লুটপাট করতে নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের জমির ভুয়া দলিল, ভুয়া নথিপত্র, ভুয়া এলসি, ভুয়া ড্রাফটসহ বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওই চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে এই বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিতে সরকারের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির কাঁধে ভর করে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে ব্যাংক ঋণের নামে গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা আত্দসাতের চমকপ্রদ সব কেচ্ছাকাহিনী। ব্যাংকপাড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি দেশের ব্যাংকিং খাতে শুধু নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকের করপোরেট ঋণের নামে যে করপোরেট লুটপাট চলছে তা অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত নজরদারির অভাব এবং নিয়মিত অডিট না হওয়ায় ব্যাংকগুলো চলছে যাচ্ছেতাইভাবে। ব্যাংক ঋণের নামে লুটপাট হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। লুটপাটের একটি অংশও যাচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পকেটে। এ সব অর্থের বেশিরভাগই আর ফেরত পাওয়া যাবে না বলে সংশয় প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে, হলমার্কের পিলে চমকানো আর্থিক কেলেঙ্কারিতে সোনালী ব্যাংকসহ দেশের সরকারি-বেসরকারি ও বিদেশি মোট ২৬টি ব্যাংকের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, হলমার্ক জালিয়াতিতে এক ব্যাংক অপর ব্যাংককে সাহায্য করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে অর্থ জালিয়াতির ঘটনা বাড়ছে, এটা খুবই উদ্বেগজনক। এ সব ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সমানভাবে দায়ী। তবে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বিচার হওয়া দরকার। আর যেহেতু সোনালী ব্যাংক একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক তাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সরকারেরই। এ ধরনের ঘটনা ব্যাংকিং খাতের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সরকার সমানভাবে দায়ী। শোনা যাচ্ছে এ ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনও জড়িত। তাদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যারা দোষী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকরা এ সব অনিয়মের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এদের অধিকাংশেরই ব্যাংক পরিচালনার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি ওই পরিচালকদের দাপটে প্রকৃত ব্যাংকিং জানা পরিচালকরা থাকছেন কোণঠাসা। এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ধীরে ধীরে চাপের মধ্যে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ সব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠিও দিয়েছেন। সরকারি ব্যাংকগুলোতে তিন বছর ধরে অবিরাম লুটপাট ও অনিয়ম চললেও অদৃশ্য কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয়ের নজরে আনা হয়নি। এমনকি ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ অডিটেও সেগুলো ধরা পড়েনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, হলমার্কের ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবারই প্রথম পরিদর্শন দল তৈরি করেছে। পরিদর্শন দল ব্যাংকের ঋণ সম্পর্কিত বিষয়গুলো তদারকি করবে।

সূত্র জানায়, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, কৃষি ও বেসরকারিসহ ২৫টি ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়। ব্যাংকগুলো রপ্তানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে এ সব টাকা লোপাট করেছে। ব্যাংকগুলো থেকে এই বিপুল অর্থ সরিয়ে ফেলার সঙ্গে ব্যাংকের ঊধর্্বতন কিছু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে এ সব ব্যাংকের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়েছে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, করপোরেট গ্রাহকের অনুকূলে ঋণপত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই শাখা ব্যবস্থাপকরা ক্ষমতাবহিভর্ূতভাবে ঋণপত্র স্থাপন করেছেন। কোনো ধরনের সহায়ক জামানত ছাড়াই অনেক সময় নন-ফান্ডেড ঋণ (ডেফার্ড এলসি ও সাইট এলসি) সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নিরীক্ষায় সোনালী ব্যাংক থেকে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা সরিয়ে ফেলার তথ্য বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে হলমার্ক গ্রুপ একাই তুলে নেয় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি। এখন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আত্দসাতের ঘটনা যে কোনোভাবে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অথচ বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা ওপর মহলের চাপে এ কাজে বাধ্য হয়েছে বলে জানালেও সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সব দায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উপর চাপিয়েছে। আর অর্থ আত্দসাতের দায় স্বীকারের পরও হলমার্কের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় অর্থ ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে হলমার্কের ঋণ কেলেঙ্কারিতে এ দেশে ব্যবসারত ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক আল ফালাহ লিমিটেড এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া সোনালী ব্যাংক ছাড়াও আরও ২২টি ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এলসি বিল কিনে পে-অর্ডার ও ড্রাফটের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা অন্যত্র সরিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। নিয়ম অনুযায়ী বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এলসি বিল কিনতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে সংশ্লিষ্ট এলসি বিলের বৈধতা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু হলমার্কের ক্ষেত্রে এলসি বিলগুলো বৈধ কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। শীর্ষ কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা ছাড়া এ ধরনের অনিয়ম করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বৈধতা নিশ্চিত না করে ব্যাংকগুলো কেন এ ধরনের ভুয়া এলসি বিল কেনার সঙ্গে জড়িত হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তবে তারা খোঁড়া যুক্তি উপস্থাপন করে বলছেন, সোনালী ব্যাংক গ্যারান্টার হওয়ায় তারা এ সব বিল কিনেছে। এ ধরনের যুক্তি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ যে কোনো ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তা কার্যক্রম রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে এ অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের মতো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোরও শীর্ষ কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুয়া এলসি, ভুয়া ড্রাফট ছাড়াও ভুয়া জমির দলিল বা অল্প মূল্যের জমি বেশি মূল্য দেখিয়ে দলিল জমা দিয়ে বিপুল অংকের টাকা ঋণের নামে লুটে নিচ্ছে চক্রটি। সূত্র জানায়, মিরপুর এলাকার একাধিক মালিকানা দাবির জমির দলিল, ভুয়া দলিল জমা দিয়ে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্দসাৎ করছে। এছাড়া অল্প মূল্যের জমিও কয়েকগুণ বেশি দেখিয়েও হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্দসাৎ করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, হলমার্ক গ্রুপ আত্দসাতের অর্থ ফেরত দিতে এরই মধ্যে নগদ ও এঙ্পোর্ট বিল বাবদ ২৭৭ কোটি টাকা দিয়েছে। আর বন্ধক হিসেবে সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় ২১৪৩ শতাংশ জমির কাগজপত্র জমা দিয়েছে। যার মূল্য ধরা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রতি শতাংশ জমির দাম ধরা হয়েছে ৯৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ এলাকার উঁচু জমির দাম সর্বোচ্চ শতাংশ প্রতি ৫ লাখ টাকা। ফলে সোনালী ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা জমির মূল্য বাজার দরের চেয়ে ১৯ গুণ বেশি দেখিয়েছে হলমার্ক গ্রুপ।

এছাড়া ব্যাংক জালিয়াতির আরও অভিনব ফাঁদ আবিষ্কার করেছে চক্রটি। জালিয়াত চক্রের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি যোগ দিয়েছেন ব্যাংকের কর্মকর্তাও। চক্রের সদস্যদের মধ্যে একই ব্যক্তি বিভিন্ন ছদ্মনাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে এমনকি ভুয়া পিতার নাম, ভুয়া জন্মতারিখ ও নীলক্ষেত থেকে ভুয়া জাতীয়তার সনদ তৈরি করে রাজধানীতে বেসরকারি ১৬টি ব্যাংক, একটি সরকারি ব্যাংক এবং চট্টগ্রামের একটি ব্যাংকে একাধিক অ্যাকাউন্ট খোলে। পরে সেই ব্যক্তিই আবার এক ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে আরেক ব্যাংকে জমা করে এবং সেই টাকা কৌশলে তুলে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তারা ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তায় ভুয়া ব্যাংক ভাউচার, ভুয়া জমার রসিদ, পে-অর্ডার প্রভৃতিও তৈরি করে। চক্রটি সোনালী ব্যাংক মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট শাখা থেকে কৌশলে ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা সরিয়ে ওই ১৮টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে তুলে নেয়।

এরও আগে ২০০২ সালে ওম প্রকাশ আগারওয়াল নামে এক ব্যবসায়ী পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে উধাও হয়ে যান।

এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট পাঁচটি ব্যাংকের এমডিকে অপসারণ করে। এর আগে আশি ও নব্বই দশকেও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার সংস্কৃতি চালু ছিল। তবে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও অর্থ জালিয়াতির ঘটনা সব অতীতকে হার মানিয়েছে।

No comments:

Post a Comment